E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

রোহিঙ্গা ব‍্যবস্থাপনায় অদূরদর্শিতা ভবিষ‍্যৎ প্রজন্মের জন‍্য অশনিসংকেত

২০২৫ মে ১৯ ১৭:১৪:১৮
রোহিঙ্গা ব‍্যবস্থাপনায় অদূরদর্শিতা ভবিষ‍্যৎ প্রজন্মের জন‍্য অশনিসংকেত

চৌধুরী আবদুল হান্নান


ব্রিটিশরা ১৮২৬ সালে মিয়ানমারের আরাকান দখল করে নেওয়ার পর কৃষি শ্রমিক হিসেবে উভয় বাংলা থেকে অনেক মুসলমানকে সেখানে নিয়ে যায়, তারাই রোহিঙ্গা নামে পরিচিত। তাদের কাজ ছিল পাহাড়, জঙ্গল পরিস্কার করে জমি আবাদযোগ‍্য করা।

বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) সামরিক শাসক ১৯৮২ সালে দেশের সংবিধান সংশোধন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দিলে তারা রাষ্ট্রহীন মানুষে পরিণত হয়। এর পরই দেশ থেকে বিতাড়নের উদ্দেশ‍্যে শুরু হয় তাদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন। নৃশংসতা এমন পর্যায়ে পৌছায় যে, প্রাণ বাঁচাতে তারা নিজ গৃহ ত‍্যাগ করে নিঃস্ব হাতে অজানার পথে যাত্রা শুরু করে।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক নির্বিচারে হত‍্যা আর ঘরবাড়ি পুড়িয়ে এমনই নির্মম অত‍্যাচারের শিকার হয়েছিল বাঙালিরা। সে বিভীষিকার স্মৃতি আজও ম্লান হয়নি।

বাংলাদেশ বাস্তুহারা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয় এই ভরসায় যে, দ্রুত সময়ের মধ‍্যে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে। কিন্ত তা হয়নি। বরং বর্তমান সময়ে দেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে দেশে বিরাজমান অস্থিতিশীলতার সুযোগে নতুন করে ১ লাখ ১৩ হাজার রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে এবং প্রায় প্রতিদিন তারা বাংলাদেশে ঢুকছে।

অনেকবার মিয়ানমারের সাথে দ্বিপক্ষীয় উদ‍্যোগ নেওয়া হলেও একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।

যে দেশের সরকার ৪৩ বছর পূর্বে নতুন আইন করে যাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছে আর ঘরবাড়ি পুড়িয়ে চরম নির্যাতনের মাধ‍্যমে বাস্তুহারা করে তাড়িয়ে দিয়েছে, তারা স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে, এমন ভাবনা মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

বাংলাদেশে যদি এখনই রোহিঙ্গা ইনফ্লাক্স বন্ধ করা না যায়, তাহলে এক সময় বাংলাদেশের ভূমিতে স্বাধীনভাবে বসবাস করার জোর প্রচেষ্টা চালাবে না, তা বলা যায় না।

খৃষ্টানদের হাতে ইহুদিরা নানা কারণে পৃথিবীময় প্রাচীনকাল থেকেই নিদারুণ নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ইহুদি নিধন কর্মসূচীতে লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে ঠান্ডা মাথায় হত‍্যা করা হয়।

অবশ‍্যম্ভাবী বিলুপ্তির হাত থেকে যে জাতি নিজেদের রক্ষা করতে সমর্থ হয়, তারা অবশেষে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়।এমন দৃষ্টান্ত ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল।

১৯১৭ সালে কূটনৈতিক স্বার্থে ইহুদিদের জন‍্য নিজস্ব আবাসভূমি তৈরি করে দেওয়ার ব্রিটিশ ঘোষণা, দুটি বিশ্বযুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় অবশেষে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে প‍্যালেস্টাইন ভূখন্ডে ইহুদিদের নিজস্ব আবাসভূমি ইসরাইল আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমানে এই ইহুদি রাষ্ট্রটি মানুষ হত‍্যা আর সম্পদ ধ্বংসের মাধ‍্যমে একটি রক্তাক্ত প্রান্তরে পরিণত হয়েছে।

বৃহৎশক্তির প্রভাব বলয়ে থেকে ইসরাইল মানুষ খুন আর সন্ত্রাসের মাধ‍্যমে ফিলিস্তিনের মূল অধিবাসীদের দেশত‍্যাগে বাধ‍্য করছে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ইহুদিদের নাগরিকত্ব দিয়ে চলেছে।

বাংলাদেশে আশ্রীত রোহিঙ্গারা ইহুদিদের মতো আন্তর্জাতিক সহায়তায় এক সময় শক্তিশালী হয়ে উঠবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

১৪ মে, ১৯৪৮ সালে ইহুদি নেতারা ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথে ৫টি আরব দেশ একযোগে ইসরাইলের ওপর হামলা চালায়। এক পর্যায়ে ইসরাইলের সেনাবাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পিছু হঠতে বাধ‍্য হয়। কিন্ত এমন সময় জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে যুদ্ধ বিরতি হয়, আসলে এটা ছিল ইহুদিদের বিজয়ী করার আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক কৌশল। অনুরূপ একটি ঘটনা ঘটেছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, এক পর্যায়ে আক্রমণকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পূর্ব পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব উপস্হাপন করা হলে তৎকালীন সোভিয়ত ইউনিয়ন ভেটো প্রয়োগ করে, তা বাতিল করে দেয়। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম নিশ্চিত হয়ে যায়, অন‍্যথায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয়ে বাংলাদেশকে মার্কিন-ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভাগ‍্য বরণ করতে হতো।

সাময়িক আশ্রয়প্রাপ্ত রোহিঙ্গাদের জন‍্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো সুযোগ মতো বাংলাদেশের ভূমিতে স্থায়ী করার উদ‍্যোগ নেবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

ইতোমধ‍্যে এমন লক্ষণ দৃশ‍্যমান হচ্ছে, নতুন আগত রোহিঙ্গাদের জন‍্য ঘর তৈরি করে দিতে জাতিসংঘের চিঠি আমাদের বাড়তি উদ্বেগের কারণ।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের রাখাইনের মধ‍্যে একটি করিডোর স্থাপনের জাতিসংঘের প্রস্তাব কিসের ইঙ্গিত? প্রশ্ন থেকেই যায়, রোহিঙ্গা প্রত‍্যাবাসনে জাতিসংঘ এতদিন কী করেছে?

রোহিঙ্গা শরনার্থীদের আশ্রয় দিয়ে জাতিসংঘসহ মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রশংসা কুড়িয়েছে বাংলাদেশ। কিন্ত এমন একটি মানবিক মহৎ কাজ অচিরেই আত্মঘাতী কর্মকান্ড হিসেবে দেখা দেবে তা আগে কেউ ভাবতে পারেনি।

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের (বিহারী) শত চেষ্টা করেও একজনকেও ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।

এ সকল বিহারীদের নির্দিষ্ট ক‍্যাম্পে থাকার কথা ছিল কিন্ত তারা ছড়িয়ে গেছে তাদের পছন্দ মতো জায়গায়। তবে বিহারী ক‍্যাম্পগুলো আছে ঠিকই, তা ব‍্যবহৃত হচ্ছে মাদক আর চুরি-ডাকাতির কেন্দ্র হিসেবে। তারা সমাজ ব‍্যবস্থায় এতদিনে কতটা বিষ ছড়িয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই।

দেশে অবস্থান নেওয়া ১৩ লক্ষ রোহিঙ্গা ও নতুন করে আসতে থাকা এবং তাদের দ্রুত বংশবৃদ্ধির মাধ‍্যমে জনসংখ‍্যার ওপর যেমন বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে এবং আইন শৃঙ্খলা অবনতিতেও যথেষ্ট অবদান রাখছে।

অন‍্যদিকে রোহিঙ্গারা ধীরে ধীরে শক্তিমত্তা অর্জন করলে দেশের রাজনীতিতে তারা একটা ফ‍্যাক্টর হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।

রোহিঙ্গারা তো বাংলার পূর্ব পুরুষদের বংশধর এবং মুসলমান , ধর্মকে ব‍্যবহার করে রাজনীতিতে যারা অধিক ফায়দা নিতে চায়, তারা তাদের ব‍্যবহার করার সুযোগ খুঁজতে পারে।

ক্ষমতার রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই আর বলা হয় বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ।

বর্তমান সরকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত নয়, সে কারণ শক্তিশালী সরকার বলা যায় না। রোহিঙ্গা প্রত‍্যাবাসন প্রক্রিয়ায় দেশের স্বার্থ রক্ষায় শক্ত অবস্থান নিতে দেখা যাচ্ছে না।

সরকার প্রধান বিশ্ববরেণ‍্য সম্মানিত ব‍্যক্তি, তিনি রাজনীতিক নন, কূটনীতিকও নন। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উপদেষ্টাদের যৌক্তিক এবং বুদ্ধিদীপ্ত পরামর্শ তাঁর দেশ পরিচালনায় সহায়ক হবে।

শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া অধ‍্যাপক ইউনূসের দেশ অশান্তিতে ভরে যাক, তা কারও কাম‍্য নয়।

আর মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধের অবসান হয়ে কতদিনে দেশটিতে শান্তি ফিরবে, তা অজানা।

মিয়ানমারে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ার অজুহাতে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর পরিবর্তে এই দেশেই স্থায়ী ঠিকানা গড়ে দেওয়ার নীল নকশা রয়েছে কিনা তা দ্রুত নিশ্চিত হতে হবে। অন‍্যথায় অদূর ভবিষ‍্যতে বাংলাদেশ ভূখন্ডটি ফিলিস্তিন-গাজার ভাগ‍্য বরণ করার আশংকা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে ভবিষ‍্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব‍্যাংক।

পাঠকের মতামত:

১৯ জুন ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test