E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

পাপোশ তৈরি করে ভাগ্য বদল ২০০ নারীর 

২০২৩ জুলাই ১৭ ১৬:০৭:৫৬
পাপোশ তৈরি করে ভাগ্য বদল ২০০ নারীর 

ছাদেকুল ইসলাম রুবেল, গাইবান্ধা : বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে পড়াশোনা ছাড়তে হয় হালিমা বেগমকে। এক বছর যেতে না যেতেই তার কোলজুড়ে আসে এক ছেলে সন্তান। আর তখনই জীবিকার তাগিদে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান হালিমার স্বামী বিপ্লব ইসলাম। এরপর থেকেই যেন থমকে যায় হালিমার জীবন। স্ত্রী-সন্তানের খোঁজ নেন না বিপ্লব। তারপরও স্বামীর পথ চেয়ে দীর্ঘদিন অনেক কষ্টে শ্বশুরবাড়িতেই থেকে যান হালিমা। পরে আর কোনো উপায় না পেয়ে আশ্রয় নেন বাবার বাড়িতে।পাপোশ যেন নয়, যেন সোনার কাঠি ছোয়ই ভাগ্য বদল ২০০ নারীর।

হালিমা হঠাৎ একদিন জানতে পারেন গাইবান্ধা সদর উপজেলার বল্লমঝাড় ইউনিয়নের ধানঘড়া এলাকায় দরিদ্র নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিচ্ছে নিরাশা দূরীকরণ আর্থসামাজিক উন্নয়ন সংস্থা (ডিএসডিও) নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এরপর তিনি সময় নষ্ট না করে ডিএসডিওর প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে পাপোশ তৈরির কাজ শিখে ফেলেন। পরে সেখানেই তার কর্মসংস্থান হয়ে যায়।হালিমা প্রায় ছয় মাস ধরে পাপোশ বানানোর কাজ করছেন।

তিনি বলেন, কিছুদিন আগেও খুব হীনমন্যতায় ভুগতাম। বাচ্চাটাকে নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলাম। এখন আর সেই চিন্তা নেই। ডিএসডিওতে কাজ করে ভালোই আয় হয়। মাসে প্রায় সাত-আট হাজার টাকা পাই। তা দিয়ে সংসারে সচ্ছলতা এসেছে। এ খবর শুনে স্বামীও যোগাযোগ করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দরিদ্র, বিধবা, এতিম ও অসহায় নারীদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে নারী উদ্যোক্তা সাবিনা ইয়াসমিনের হাত ধরে সদর উপজেলার বল্লমঝাড় ইউনিয়নের মধ্য ধানঘড়া এলাকায় চলতি বছরের ১ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে নিরাশা দূরীকরণ আর্থসামাজিক উন্নয়ন সংস্থা (ডিএসডিও)। প্রথমদিন থেকেই দরিদ্র নারীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রশিক্ষণ শেষে ওই নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগও করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

সরেজমিনে দেখা যায়, গাইবান্ধা জেলা শহরের অদূরে ডিএসডিও পাপোশ তৈরির কারখানা গড়ে তুলেছে। ভেতরে ঢুকতেই তাঁতের খটখট শব্দ। কোনো কোনো নারী তাঁতে পাপোশ বুনছেন। কেউ পাপোশ ডিজাইন করছেন। কেউ মেশিনে সুতা থেকে পাপোশের জন্য রশি বুনছেন। পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা কাজগুলো তদারকি করছেন।

সদর উপজেলার ত্রিমোহনী গ্রামের অটোরিকশাচালক রুহুল আমিন ছয় সদস্যের সংসার চালাতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছিলেন। তাই তার স্ত্রী শারমিন বেগম (৩২) ঘরে বসে না থেকে কাজ শুরু করেন। চার মাস ধরে পাপোশ তৈরির কাজ করছেন তিনি। এতে শারমিনের সপ্তাহে প্রায় দেড় হাজার টাকা আয় হয়, তা দিয়ে অভাবের সংসারে কিছুটা হলেও সচ্ছলতা ফিরেছে।

শারমিন বেগম বলেন, স্বামী রিকশা চালিয়ে যে আয় করে তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই ঘরে বসে না থেকে ডিএসডিও থেকে পাপোশ বানানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছি। প্রায় চার মাস ধরে এখানেই কাজ করছি। যা আয় হয় তা দিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ চালানোর পরেও সংসারে কাজে ব্যয় করতে পারছি। দুইজনে কাজ করায় আগের মতো আর অভাব-অনটন নেই। এখন সুখেই আছি।

হালিমা বেগম আর শারমিন বেগমের মতো কুলছুম আক্তার, সঞ্চয় ইসলাম সালমা, রোশনা বেগম, মুক্তি বেগম, আঁখি আক্তারসহ প্রায় দুই শতাধিক নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে এই পাপোশ কারখানায়। তারা এখানে কাজ করে নিজেদের সংসারের অভাব ঘুচিয়েছেন। এখন আর আগের মতো সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালাতে টানাপোড়েনে পড়তে হয় না তাদের।

ডিএসডিও কর্তৃপক্ষ জানায়, দরিদ্র নারীদের হাতে-কলমে পাপোশ তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কাজ দেওয়া হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন পোশাক কারখানা থেকে ঝুট কাপড় সংগ্রহ করে তাঁতের মাধ্যমে পাপোশ তৈরি করা হয়। এরপর সেলাই মেশিনে সেগুলোতে ডিজাইন করা হয়। প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে মাসে সাড়ে সাত থেকে আট হাজার পাপোশ উৎপাদন হচ্ছে। স্থানীয় বাজারে প্রতিটি পাপোশ পাইকারি দরে প্রকার ভেদে ২৬ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ১০০ টাকায়।

ডিএসডিওর প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর মো. শামীম হোসেন বলেন, নারী উদ্যোক্তা সাবিনা ইয়াসমিন দরিদ্র ও অসহায় নারীদের কর্মমুখী করতে পাপোশ কারখানা করেছেন। এখানে প্রায় ২০৩ জন নারী প্রশিক্ষণ নিয়ে ভালো মজুরিতে কাজ করছেন। এতে তাদের সংসারের অভাব ঘুচেছে। সবার সহযোগিতা পেলে এখানে আরও নারীর কর্মসংস্থান করা সম্ভব।

ডিএসডিওর নির্বাহী পরিচালক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, একটা সময় এনজিওতে কাজ করেছি। তখন দেখেছি সমাজে নারীরা অনেক অবহেলিত। তাদের কথা চিন্তা করেই এ প্রতিষ্ঠানটি করেছি। এতে প্রায় ২০০ দরিদ্র নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। তারা সবাই প্রোডাকশনে কাজ করছে। এছাড়া এই প্রতিষ্ঠানে ৩০ জন বেকার তরুণ-তরুণী অন্য কাজ করছেন।

তিনি আরও বলেন, এখানে উৎপাদিত পাপোশের চাহিদা স্থানীয় বাজারে প্রচুর। মূলধনের অভাবে চাহিদা অনুযায়ী পাপোশ উৎপাদন করতে পারছি না।

গাইবান্ধা বিসিকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক রবীন চন্দ্র রায় বলেন, প্রতিষ্ঠানটিকে কুটির শিল্পে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। পরে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালকসহ তিনজনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তারা দরিদ্র নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর কাজের সুযোগ দিচ্ছেন। এছাড়া ওই প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

(এস/এসপি/জুলাই ১৭, ২০২৩)

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test