E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

টাঙ্গাইলে দিগন্তজুড়ে তামাকের চাষ, স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে কৃষক

২০১৯ ফেব্রুয়ারি ০৬ ১৭:০৭:০৭
টাঙ্গাইলে দিগন্তজুড়ে তামাকের চাষ, স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে কৃষক

রঞ্জন কৃষ্ণ পন্ডিত, টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলে কৃষকরা অল্প সময়ে অধিক অর্থ লাভের আশায় স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে তামাকের চাষ করছে। নানা প্রণোদনায় কৃষকরা কয়েক বছর তামাকের পরিবর্তে ভুট্টা চাষে আগ্রহী হলেও এবার দিগন্তব্যাপী বিষবৃক্ষ নামক তামাকের চাষ ছড়িয়ে পড়েছে। টোব্যাকো কোম্পানীর প্রলোভনে পড়ে অধিক লাভের আশায় কৃষকরা তামাক চাষের দিকে ঝুঁকছে। তামাক চাষে ‘কারগিল’ নামক সার প্রয়োগের ফলে চাষি ও তার পরিবারের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে, ফসলি জমির উর্বরা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে।

জানা গেছে, টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলার গোপালপুর, ভূঞাপুর, কালিহাতী, টাঙ্গাইল সদর, দেলদুয়ার ও নাগরপুর উপজেলার চরাঞ্চলে ব্যাপক হারে তামাক চাষ হচ্ছে। জেলার এ ৬টি উপজেলার পশ্চিম এলাকা চরাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। যমুনা, ধলেশ্বরী, লৌহজং ও নিউ ধলেশ্বরী নদীর তীর ঘেষা এসব চরাঞ্চলে প্রতিবছরই বর্ষাকালে পলি পড়ে। ফলে এসব এলাকার জমি উর্বর হয়ে থাকে। জমিগুলো বালি ও দো’আশ মাটি হওয়ায় এক সময় মশুর ও মাস কলাই, ভূট্টা, চিনা, কাঊন, গম, আলু, আখ, বাদাম ইত্যাদি ফসল বেশি পরিমাণে উৎপাদন হত।

স্থানীয় কৃষকরা বহুজাতিক ও দেশীয় টোব্যাকো কোম্পানীর প্রলোভনে পড়ে ওইসব ফসল চাষ না করে বেশি লাভের আশায় ‘বিষবৃক্ষ’ তামাক চাষের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠছে। বাংলাদেশে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ ও উৎপাদন বন্ধ করে সরকার বিকল্প কৃষিজ উৎপাদনে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করায় কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের তৎপরতায় ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত জেলায় তামাক চাষ অনেকটাই কমে গিয়েছিল। কিন্তু এ বছর টোব্যাকো কোম্পানীর প্রতিনিধিরা কৃষকদের অধিক মুনাফার পাশাপাশি সার, বীজ ও সেচের জন্য নগদ টাকা মূলধন(ঋণ) হিসেবে দেয়ায় আবার তামাক চাষের পরিমাণ কয়েকগুন বেড়েছে।

জানা গেছে, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি, ঢাকা টোব্যাকো কোম্পানী, আকিজ টোব্যাকো কোম্পানী, আবুল খায়ের টোব্যাকো কোম্পানী, বিভিন্ন বিড়ি, সিগারেট ও জর্দা কোম্পানী সহ আরো কিছু কোম্পানী তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে স্থানীয় কৃষকদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করছে। সরকারি কোনরূপ নিষেধাজ্ঞা না থাকার ফলে কৃষকদের এ চাষে উৎসাহ জোগাচ্ছে টোব্যাকো কোম্পানীগুলো।

তামাক চাষে বহুজাতিক কোম্পানীগুলো অগ্রীম টাকা, বীজ ও সার প্রদান এবং বিভিন্নভাবে তামাক চাষে সাহায্য-সহযোগিতা করছে। সরকার যখন চেষ্টা করছে তামাক চাষের পরিবর্তে অন্য ফসল চাষে কৃষকদের উৎসাহী করতে তখনই লক্ষ্য করা যাচ্ছে টোব্যাকো কোম্পানীর অপতৎপরতায় তামাক চাষ ধীরে ধীরে বাড়ছে।

টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী, জগৎপুরা বামনহাটা, চর নিকলা, নিকরাইল, পালিমা, আমুলা, ঘাটাইল উপজেলার সিংগুরিয়া, সোনাকান্দর, তালতলা, কালিহাতী উপজেলার সল্লা, দেউপুর, চর হামজানী, কদিম হামজানী, পটল, বেরী পটল, ঢোলকান, জোকারচর, গোহালিয়াবাড়ী, কুর্শাবেনু, গোবিন্দপুর, ধলাটেঙ্গর, গোপালপুর উপজেলার নলিন, শাখারীয়া, সোনামুই, কালিবাড়ী, হেমনগর, নারুচী, টাঙ্গাইল সদরের কাকুয়া, হুগড়া, কাতুলী, মামুদ নগর, চর পৌলী, দেলদুয়ার উপজেলার এলাসিন, দেউলী, লাউহাটি, নাগরপুরের পাকুটিয়া, ভাদ্রা, বেকরা, আটগ্রাম, সলিমাবাদ, ধুবুরিয়া, মোকনা, বনগ্রাম, শাহজানী প্রভৃতি অঞ্চলে দিগন্তজুড়ে তামাক চাষ হচ্ছে। এরমধ্যে ভূঞাপুর, কালিহাতী, টাঙ্গাইল সদর ও নাগরপুর উপজেলায় তামাক চাষের পরিমান সবচেয়ে বেশি। ‘ধূমপান বিষ পান’ হলেও কৃষি বিভাগের মোটিভেশন ও স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবে শুধুমাত্র অধিক লাভের আশায় চাষিরা তামাক চাষে ঝুঁকছে।

তামাক চাষে জড়িত চাষি ও তাদের পরিবারের অভিযোগ, তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক উল্লেখ বা এ চাষ বন্ধে কৃষি কর্মকর্তাদের কোনরূপ পদক্ষেপ না থাকায় দিনদিন এর ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের মতে, প্রতি শতাংশ জমি বাবদ পাঁচ কেজি সার ও পরিমাণমত তামাক বীজ সরবরাহ করছে টোব্যাকো কোম্পানী। তামাক চাষে শতাংশ প্রতি প্রায় এক হাজার টাকার তামাক উৎপাদন করা যায়। মাটির উবর্রতা শক্তি নষ্ট হওয়া সত্ত্বেও কম পরিশ্রমে তামাক অধিক লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা এ চাষে উদ্ধুদ্ধ হচ্ছে। কারগিল সার বা অতিরিক্ত সার ব্যবহারের ফলে কৃষি জমিগুলো নষ্ট হওয়ার কথাও স্বীকার করেছেন চাষিরা। কিন্তু লাভ বেশি হচ্ছে পাশাপাশি এ কথাও বলছেন।

কৃষক পরিবারগুলো জানায়, তামাক শুকানোসহ ঘরে মজুদ করে রাখতে তাদের শারীরিক নানা সমস্যা হচ্ছে। বাড়ির অনেকেরই চর্ম, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানী ইত্যাদি রোগ দেখা দিচ্ছে। তারা অভিযোগ করে বলেন, কোম্পানীগুলো তামাক চাষ বৃদ্ধিতে বীজ ও সার সরবরাহ করলেও স্বাস্থ্য সচেতনতায় গায়ে অ্যাপ্রোণ বা মাস্ক সরবরাহ করে না। এতে তাদের হাতে চর্মরোগ ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিচ্ছে।

সরেজমিনে কালিহাতী উপজেলার তামাক চাষি সাইফুল ইসলাম জানান, তিনি এ বছর ১২ একর জমিতে তামাক চাষ করেছেন। প্রতি শতাংশে তামাক চাষে খরচ হয় প্রায় এক হাজার টাকা আর বিক্রি করে লাভ হয় প্রতি শতাংশে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। এর মধ্যে বীজ, সার ও পরিচর্যার জন্য টোব্যাকো কোম্পানীর পক্ষ থেকে কার্ডধারীদের নগদ মূলধন(ঋণ) হিসেবে একর প্রতি কোম্পানীর পছন্দ মাফিক ৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দেয়া হয়। তামাক চাষ করলে একজন ব্যক্তির শুধু শরীরে খাটতে হয়, পুঁজি লাগেনা। তামাক শুকিয়ে কোম্পানীকে বুঝিয়ে দিলে লাভটা ঘরে থাকে।

তিনি জানান, এই একই জমিতে কলাই, বাদাম, চিনা ইত্যাদি চাষ করলে নিজেদের পুঁজি লগ্নি করতে হয়। শ্রমিক লাগে একা সব কাজ করা যায়না। তাছাড়া লাভ থাকে তামাকের তুলনায় অর্ধেক বা তারও কম।

প্রায় একই কথা বলেন, স্থানীয় মজনু মিয়া, জমির উদ্দিন ও কিতাব আলী। নাগরপুরের আজিজুল, মফিদুল, রূপচান টাঙ্গাইল সদরের রহম আলী, করিম মিয়া, ইন্তাজ আলী তাদের সবার বক্তব্যই প্রায় একই। তবে তারা মনে করেন, তামাক চাষ না করার জন্য আগে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা তাদেরকে বুঝাতেন, এখনও বুঝান তবে আগের মতো নয়। তাছাড়া তারা তো আর লাভ করে দিতে পারেন না। তাই বুঝালে কী হবে? অধিক লাভের জন্যই তারা তামাক চাষ করেন।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, দীর্ঘদিন তামাক চাষে যুক্ত থাকলে ক্যান্সার, পেটের পীড়া, বুক ও ঘাড়ে ব্যাথা সহ নানাবিধ জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বাড়ির পোয়াতি বৌ-ঝি’দের তামাকের কাছে ঘেষতেও নিষেধ করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এছাড়া তামাক চাষিদের সন্তানদের ‘গ্রীন টোব্যাকো সিন্ড্রম’ নামে এক জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়। স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার আগেই তামাক চাষের পরিবর্তে কৃষকদের অন্য ফসল চাষে আগ্রহী করে তুলতে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দেয়ার আহ্বান জানান স্বাস্থ্য বিভাগের বিশেষজ্ঞরা।

কৃষিবিদদের মতে তামাকের শিকড় মাটির অনেক গভীর থেকে খাদ্য উপাদান সংগ্রহ করে। ফলে তামাকের জমিতে ৪-৫ বছর পর্যন্ত অন্য ফসল উৎপাদন হয় না। এছাড়া তামাক গাছের পাতা বড় করার জন্য ৩-৪ ফুট লম্বা হলেই মগডাল ভেঙে ‘কারগিল’ নামক সার প্রয়োগ করা হয়। এই ‘কারগিল’ সার অতিমাত্রায় ব্যবহারের ফলে জমির উবর্রতা শক্তি মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক জানান, সরকারি ভাবে তামাক চাষে আমরা কোন উৎসাহ দেইনা। বিধি-নিষেধ না থাকায় তামাক চাষের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তামাক চাষকে আমরা নিরুৎসাহিত করার জন্য পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। তামাকের পরিবর্তে ভুট্টা চাষে আগ্রহী হচ্ছে কৃষক।

(আরকেপি/এসপি/ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০১৯)

পাঠকের মতামত:

২২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test