E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলে বিলুপ্তির পথে কাউন চাষ  

২০২১ মে ২৫ ১৬:০৫:২৮
কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলে বিলুপ্তির পথে কাউন চাষ  

প্রহলাদ মন্ডল সৈকত, রাজারহাট (কুড়িগ্রাম) : ‘বাহে বাপ-দাদারা আগোত কাউনের আবাদ করছিল, মাঝখানোত আবাদ বন্ধ হয়া যায়। গতবার থাকি মানুষের দেকাদেকি হামরাও আবাদ করছি। কিন্তু লেদা পোকা হামার সর্বনাশ করি দ্যাইল।’ 

২৫ মে মঙ্গলবার এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করলেন কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চর ফারাজী গ্রামের কৃষক আবুল হোসেন (৩২)। তিনি দুই বিঘা জমিতে কাউন চাষ করেছেন। জমির চল্লিশভাগ কাউন লেদা পোকার আক্রমনে বিনস্ট হয়ে গেছে। ফলে হতাশা ফুটে উঠেছে তার চোখে মুখে। তিনি বিষন্ন স্বরে জানালেন, ‘দুই বিঘায় ৮হাজার টেকার উপরে খরচ গ্যাইছে। গায়ে গতরে কষ্ট করলং কিন্তু লাভ হইল না।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে সাড়ে ৬শত হেক্টর জমিতে কাউনের আবাদ করা হয়েছে। প্রায় একযুগ ধরে এসব এলাকায় কাউনের আবাদ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছিল। গত বছর থেকে কৃষকরা পূণরায় কাউন আবাদ শুরু করে। ভাতের বিকল্প হিসেবে এবং কাউনের পায়েস এই এলাকার জনপ্রিয় খাবার। এছাড়াও পশু-পাখি এবং বিভিন্ন খাদ্য পণ্যে কাউন ও কাউনের চাল ব্যবহার করা হয়। জেলা কৃষি অফিস কাউনের আবাদ সম্প্রসারণের জন্য কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে আধূনিকজাতের প্রায় ৭ কেজি বারী কাউন-৩ কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করে। কিন্ত বিরুপ আবহাওয়া এবং কীটনাশক কাজ না করায় কৃষক ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

চর ফারাজী পাড়া গ্রামের হুজুর আলীর পূত্র কৃষক বাচ্চু মিয়া (৫২) জানান, ‘হামার পরিবারে ১৩জন খাওয়াইয়া। ৩বিঘা কাউন আর ৭ বিঘা জমিত চিনা লাগাইছি। এগুলা দিয়ে সংসারের খারচ-খালা চালাই। কিন্তু কাউন আবাদ করি ধরা খায়া গেইলং।’

একই গ্রামের মৃত অতিবুদ্ধির পূত্র ছামাদ আলী (৬৫) ও মৃত ছকিমুদ্দির পূত্র মোক্তার আলী (৫৫) ২বিঘা করে ৪বিঘা জমিতে কাউন চাষ করেছেন। বিঘায় খরচ ৪হাজার টাকা। উৎপাদন হয় ৭ থেকে ৮মন। প্রতিমন কাউনের মূল্য ১২শ’ থেকে ১৩শ’ টাকা হলে বিঘায় ৯হাজার টাকার কাউন বিক্রি করা যায়। এতে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা লাভ হয়। এবার মোক্তার আলীর ২বিঘা জমির মধ্যে ১৬শতক জমিতে পোকার আক্রমন হয়েছে। সেই ক্ষেতের ফসল কেটে এখন গরুকে খাওয়াচ্ছেন তিনি। এমন হতাশাজনক অবস্থা সবার।

ওই গ্রামের শাহাবুদ্দির পূত্র শাহাদত (৪০) জানান, এবার কৃষি বিভাগের পরামর্শে কীটনাশক প্রয়োগ করেছি। কোন কাজ হয়নি। বিষয়টি তারা জানেন কিন্তু প্রতিকার পাইনি।

কৃষক খয়বর আলী (৫৫) জানান, ‘বাহে বিএস’র কথাত ঔষধ ছিটালং কিন্তু কাজতো হইল না। পোকাগুলো ২/৩ঘন্টা টাসকি নাগি থাকার পর ফির উঠি কাউন খাবার ধরে। হামরাতো ক্ষতিগ্রস্ত হইলং।’

এ বিষয়ে যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী সরকার জানান, বাপ-দাদার আমল থেকে চরাঞ্চলে লাভজনক ফসল কাউন চাষ করা হলেও গত এক যুগ ধরে কাউন আবাদ বন্ধ করে দিয়েছে চরাঞ্চলের কৃষকরা। আমার ইউনিয়নে গত দুই বছর থেকে বিলুপ্ত প্রায় কাউনের আবাদ শুরু হয়েছে। এবার দেড়শ একর জমিতে আবাদ হলেও এর ৩০ভাগ পোকার আক্রমনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষি বিভাগ সঠিকভাবে দেকভাল করলে কৃষক ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে আবার কাউন চাষে আগ্রহী হয়ে উঠবে।

মঙ্গলবার এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হক জানান, চরগুলোর মাটি কাউন, চিনা, সরগম আবাদের জন্য খুবই উপযোগী। এবার কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে আধূনিকজাতের বারী কাউন-৩ কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করা হয়েছে। যাতে অভাবের ফসলগুলো উচ্চ মূল্যের ফসলে পরিণত হয়। স্থানীয়জাতগুলোতে কিছুটা পোকার আক্রমন হয়েছে। আমরা দমনের জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছি বলে এই শীর্ষ কর্মকর্তা জানান।

এদিকে অধিক অর্থ ব্যয় করে কৃষক যদি লাভবান হতে না পারে তাহলে আবার এই ফসলটি হারিয়ে যেতে পারে পারে। এটি রক্ষায় কৃষি বিভাগ কৃষকদের পাশে দাঁড়াবে। সেই সাথে চরাঞ্চলের প্রান্তিক মানুষ কাউনচাষ করে বিকল্প খাদ্য হিসেবে ভাতের অভাব মেটাতে পারবে এই প্রত্যাশা ওই এলাকার সাধারণ মানুষের।

(পিএস/এসপি/মে ২৫, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test