E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

ইঁদুরের উৎপাত থেকে ফসল বাঁচাতে শ্যামনগরে মরণফাঁদ পেতেছে কৃষকরা

২০২৫ মার্চ ০৭ ১৯:৪২:৪৯
ইঁদুরের উৎপাত থেকে ফসল বাঁচাতে শ্যামনগরে মরণফাঁদ পেতেছে কৃষকরা

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : ইঁদুরের উৎপাত থেকে ফসল রক্ষায় জমিতে বৈদ্যুতিক ফাঁদ (মরণ ফাঁদ) পেতেছে শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষকেরা। সেই ফাঁদে পড়ে কৃষকের ফসল রক্ষাকারি ইঁদুরভোজী প্রাণী পেঁচা, শিয়াল, বেজি, সাপ, গুঁইসাপসহ বিভিন্ন প্রাণী মারা যাচ্ছে। এছাড়াও ইঁদুর নিধনের এই মরণ ফাঁদে পড়ে অসাবধানতাবসত কৃষকসহ সাধারণ মানুষেরও মৃত্যুর খবর শোনা যায় বিভিন্ন সময়ে।

এমনকি পোল্ট্রি ফার্মের চারিপাশে রাতে শিয়াল তাড়াতে তারে বৈদ্যুতিক সংযোগ দিয়ে রাখছে খামার মালিকরা। যাহা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। পূর্বে ফসলের ক্ষেতে বৈদ্যুতিক সংযোগ দিয়ে ইঁদুর নিধন তেমনটা না থাকলেও বর্তমানে কৃষকের ক্ষেতে ইঁদুরের অত্যাচার দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় নিরুপায় হয়েই কৃষকরা ক্ষেতে বিদ্যুত সংযোগ দিয়ে ইঁদুর নিধন করছেন।

বংশীপুর-মুন্সিগঞ্জ সড়কের ধানখালি নামক স্থানে ধানক্ষেতে কাজ করছেন। কাছে যেতে দেখা যায় নিচে চিকন গুনা তার দিয়ে জমির আইলে ইঁদুর মারতে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে ফাঁদ পাতার ব্যবস্থা করছেন প্রিয়জিত মন্ডল নামের এক কৃষক। অবৈধ এই মৃত্যু ফাঁদ কেন দিচ্ছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন ইঁদুর নিধনে বিকল্প কিছুই কাজে আসে না, বাধ্য হয়েই করতেছি।

মুন্সিগঞ্জ ধানখালী এলাকার কৃষক প্রিয়জিত মন্ডল একা নয় উপজেলা জুড়ে প্রায় সব কৃষকই এই মরণ ফাঁদ দিয়ে ইঁদুর নিধনের চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে একাধিক কৃষকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর আগাম বৃষ্টি হওয়ায় ধানের খেতগুলো সবুজে সবুজে ছেয়ে গেছে। ভালো ফলনের প্রত্যাশায় কৃষকের চোখে মুখে আনন্দের ছাপ দেখা দিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে ইঁদুরের আক্রমণে কৃষকরা অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েছে। দলবেঁধে ইঁদুর আক্রমণ করে ধানের গাছগুলো কেটে সাবাড় করছে। এর ফলে জেলার কৃষকরা পড়েছেন বিপাকে। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও তারা ইঁদুর মারতে ব্যর্থ হওয়ায় বাধ্য হয়ে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে ইঁদুর নিধন করছেন তাঁরা।

গতবছর উপজেলা মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের উত্তর কদমতলা এলাকায় বোরো ধান ক্ষেতে ইঁদুরের উপদ্রব ঠেকাতে পাতা বৈদ্যুতিক ফাঁদে বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠ হয়ে শোকর আলী গাজী (৫৮) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়। শোকর আলী গাজী গ্রামের মৃত মোবারক গাজীর ছেলে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে এমন মৃত্যুর খবর আর হামেশাই পাওয়া যায়।

শুধু এই ঘটনাই নয়, মাঝে মধ্যেই শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ইঁদুর মারা বৈদ্যুতিক ফাঁদে মরার খবর পাওয়া যায়। কৃষকরা ধান, গম, সবজিসহ বিভিন্ন ক্ষেতে ইঁদুর ঠেকাতে গুনা তারে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে রাখছেন। দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ এই ফাঁদ বন্ধে সরকারি-বেসরকারি কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে ইঁদুর মারার ফাঁদ এখন মানুষ মারার ফাঁদ।

অবৈধ জেনেও কেন এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছেন জানতে চাইলে মুন্সিগঞ্জের ধানখালী এলাকার কৃষক প্রিয়জিত মন্ডল জানান, বিষটোপ, ইঁদুর নিধন ট্যাবলেট, পলিথিনের নিশানা আর কলাগাছ পুঁতেও কূলকিনারা না পেয়ে ‘বৈদ্যুতিক ফাঁদ’ দিয়ে ইঁদুর নিধনের চেষ্টা করছেন তিনি।

তিনি আরও জানান, তার প্রতি বিঘা জমিতে প্রায় ছয় হাজার টাকা খরচ করে ধান লাগিয়েছে। পানির সংকট, সার-কীটনাশকের দাম বেশি। এর ওপর আবার ইঁদুরের উৎপাত। তাই বাধ্য হয়ে অবৈধ জেনেও এই কাজ করছেন তিনি।

স্থানীয়রা জানান, ঘেরের মাছ চুরি ঠেকানো, ঘেরের আইলের ফসল রক্ষা এবং কৃষি ক্ষেতের অন্যান্য ফসল রক্ষায় কৃষক জমির চারদিকে গুনা তার টানিয়ে তাতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেন। একটি তার মাটির খুব কাছাকাছি দেওয়া হয়, যাতে কোনো ইঁদুর ঢুকতে গেলে মারা যায়। আরেকটি তার ঝোলানো হয় কিছুটা ওপরে। সাধারণত বিদ্যুতের ফাঁদে কাউকে পাহারায় রাখতে হয়। কিংবা এমন কোনো চিহ্ন দিতে হয়, যা দেখে মানুষ বুঝতে পারে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাহারা বা চিহ্ন কোনো কিছুই থাকে না। এতে দুর্ঘটনা ঘটে বেশি।

ইঁদুরের উপদ্রহ বেড়ে যাওয়া ও ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক ফাদের ব্যাপারে শ্যামনগর সরকারি মহসিন ডিগ্রী কলেজের কৃষি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. শেখ আফসার উদ্দিন জানান, ইঁদুরের উপদ্রব এড়াতে ফসলের মাঠে বৈদ্যুতিক ফাঁদ দেওয়া কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। কেননা, ইঁদুরের ফাঁদ নিমিষেই মানুষের ফাঁদে পরিণত হতে পারে। তাই ইঁদুরের উপদ্রব এড়াতে বিকল্প উদ্যোগ নিয়ে কৃষকদের ফসলের মাঠে বৈদ্যুতিক ফাঁদ দেওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন।

শ্যামনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ নাজমুল হুদা জানান, বৈদ্যুতিক ফাঁদ পাতা একেবারেই অবৈধ। বৈদ্যুতিক ফাঁদ ব্যবহারে কৃষকের অনুমতি নেই। এর পরও নির্দেশনা উপেক্ষা করে অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ এই ফাঁদ তৈরি করছে। এটা বন্ধ করা যাচ্ছে না। গত বছরের তুলনায় এ বছর অনেক বেশি জমি বোরো ইরি চাষাবাদের আওতায় এসেছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক বোরো ইরি ধানের খেত পরিদর্শন করে ইঁদুর নিধন বিষয়ে কৃষকদের নানা কৌশল বা পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে। এতে চাষিরা ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে কৃষকরা ভালো ফলন ঘরে তুলতে পারবেন বলে তিনি আশাবাদী।

ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগের ব্যাপারে শ্যামনগর উপজেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সঞ্জিত কুমার মন্ডল বলেন, গুনা তার ঝুলিয়ে তাতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার কোনো অনুমতি নেই। এটা আইনের লঙ্ঘন। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও তিনি তার গ্রাহক সাধারণকে উক্ত অবৈধ কাজ করা থেকে বিরত থাকতে মাইকিং করে প্রচারের মাধ্যমে অনুরোধ করবেন বলে জানান।

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছাঃ রনী খাতুন বলেন, ‘বিষয়টি আমি জেনেছি। বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এ ধরনের মরণ ফাঁদ তৈরি অত্যন্ত অনিরাপদ ও বিপজ্জনক। ইঁদুর নিধনের জন্য আরও কার্যকরি ও নিরাপদ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা ও কৃষকদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য কৃষি বিভাগকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

(আরকে/এসপি/মার্চ ০৭, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

২২ মার্চ ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test