E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সালথার পাট চাষীরা হতাশ

২০১৬ সেপ্টেম্বর ০৪ ১৫:২৯:৩৮
সালথার পাট চাষীরা হতাশ

সালথা (ফরিদপুর) প্রতিনিধি : সোনালী আঁশ পাটের ফরিদপুর খ্যাত সালথার পাট চাষীদের মাঝে চরম দুর্দিন নেমে এসেছে। পাটের কাঙ্খিত মূল্য না পেয়ে তারা ক্রমেই পাট চাষে আগ্রহ হারিয়ে যেতে পারে। গতবারের তুলনায় উপজেলায় পাটের আবাদ কিছুটা কমে গেছে। পাটের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, পোকামাকড়ের আক্রমণ রোধে কৃষি বিভাগের সহায়তা না পাওয়া, পাট জাগ দিতে জলাশয়ের অভাব, ভালো মানের বীজ ও সার সঙ্কটে পাটের আবাদ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে কৃষকেরা জানিয়েছেন।

দেশের সর্বাধিক গুণগত মান সম্পন্ন পাট উৎপাদিত হয় এই সালথা অঞ্চলে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, উপজেলার মোট আয়তন ১৮৫.১১ বর্গ কিলোমিটার। কৃষকের চাষাবাদী জমির পরিমান ১৩ হাজার ৬শ’ ৭৫ হেক্টর। এখানে ৩০ হাজার ১শ’ ২২ টি কৃষি পরিবার রয়েছে। উপজেলায় এবছরে ১১ হাজার ৬শ’ ১০ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। ২০১২-১৩ মৌসুমে পাটের ভালো মূল্য পাওয়ায় কৃষকেরা ব্যাপকহারে পাট আবাদে ঝুঁকে পরেছিল। কিন্তু কাঙ্খিত মূল্য না পেয়ে তারা ক্রমেই হতাশ হচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে উপজেলার বিভিন্ন প্রসিদ্ধ হাটে পাট বিক্রি করতে এসে কৃষকেরা অনেকটা বাধ্য হয়েই লোকসান দিয়ে পাট বিক্রি করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে পাটের আবাদ কমে যাবে বলে কৃষকদের আশঙ্কা। তবে সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতর দাবি করছে, বর্তমানে উচ্চ ফলনশীল জাতের পাটবীজ ব্যবহারের মাধ্যমে পাটের আবাদ বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।

সালথার প্রসিদ্ধ সদর বজার, বালিয়া বাজার, ফুলবাড়িয়া, রসুলপুর, নকুলহাটিসহ পাটের বড় হাটগুলো ঘুরে দেখা গেছে, ভালো মানের এক মণ সোনালী আশ বিক্রি হচ্ছে ১৫ শ’ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৭শ’ টাকা দরে। আর সাধারণ মানের পাট বিক্রি হচ্ছে ১২ শ’ থেকে ১৪ শ’ টাকা দরে। পাটকলগুলোর ফান্দে পড়ে ফড়িয়া মহাজনদের সিন্ডিকেট দখল করেছে এসব বাজার। কৃষকেরা বাধ্য হয়ে কমমূল্যে পাট বিক্রি করছে তাদের নিকট। সংঘবদ্ধ এই চক্র আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের দাম কমে যাওয়ার অজুহাতে পাটের দরপতন ঘটাচ্ছে।

কৃষকেরা জানান, বাজারে ঘুরে কৃষকদের পাট বিক্রি করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আগে পাট নিয়ে বাজারে গেলে ব্যবসায়ীরা টানা হেচঁড়া শুরু করে দিতেন। সেখানে এখন পাট নিয়ে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বসে থেকে বাধ্য হয়ে কম মূল্যে পাট বিক্রি করছেন। সিন্ডিকেটের কারণে পাটের বাজার ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রনে চলে যাওয়ায় বর্তমানে ১ মণ পাট বিক্রি হচ্ছে ১২ শ’ থেকে সর্বোচ্চ ১৭শ’ টাকা দরে।

পাটচাষীরা জানান, চলতি বছর যে হারে পাটের দাম পাওয়া যাচ্ছে তাতে লাভতো দুরের কথা পাট চাষের খরচই উঠবে না। বীজ রোপন থেকে বাজারে আনা পর্যন্ত সব মিলিয়ে পাট চাষ করতে কৃষককে উচ্চ হারে নগদ টাকা গুনতে হয়। অনেকে টাকা ঋণ নিয়ে বরগা জমিতে পাট চাষ করেছে। এখন দ্রুত পাট বিক্রি করে তাদের ঋণ শোধ করতে হবে। নাহলে প্রতিদিনই বাড়বে সুদের কিস্তি।

বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ১ একর জমিতে পাওয়া যাচ্ছে ১২ থেকে ১৬ মন পাট। এতে সবমিলিয়ে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। অথচ বাজারে বিক্রি করে পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ২০/২২ হাজার টাকার মতো। এর ফলে পাট বিক্রি করে খরচের টাকাই উঠছেনা। এর পর আছে ব্যাংক লোন, দাদন ও বরগা নেয়ার ব্যয়। সব মিলিয়ে মোটা অংকের লোকসান গুনতে হচ্ছে কৃষকদের।

কৃষকেরা জানান, পাটের দাম কম হওয়া সত্যেও দেনা পরিশোধ করার জন্য অনেকটা বাধ্য হয়েই কৃষকরা এখন পাট বিক্রি করে দিচ্ছেন। এ সুযোগে মুনাফা লুটে নিচ্ছেন মজুদদারেরা। কৃষকরা মনে করেন, এসব পাট যদি এখন বিক্রি না করে সংরক্ষণ করা যেতো এবং পরে কোন সুবিধাজনক সময়ে সরাসরি পাটকলগুলোতে বিক্রি করা যেতো তাহলে মজুদদাররা মুনাফা লুটতে পারতো না। কৃষকেরাও উপকৃত হতো।

কৃষি অফিসার মোহাম্মাদ বিন ইয়ামিন বলেন, এ অঞ্চলে মনপ্রতি পাটের মূল্য কিছুটা কম রয়েছে। সালথায় হেক্টর প্রতি ৮-৯ বেল পাট উৎপাদন হয়েছে। প্রতি মন পাট সাড়ে ১৩ শ’ থেকে সাড়ে ১৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন।

এদিকে, ২০১৪ ইং সালে ফরিদপুরে অনুষ্ঠিত একটি নির্বাচিত পাটচাষীদের সমাবেশে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রীর উপস্থিতিতে পাট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. রাখাল চন্দ্র বর্মন অবশ্য জানান, দেশে পাটের আবাদ বৃদ্ধির লক্ষে ফরিদপুরসহ দেশের ৪৪টি জেলায় উচ্চ ফলনশীল পাটবীজ সরবরাহের প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশে সাড়ে ১৬ লাখ একর জমিতে ৮৪ লাখ বেল পাট উৎপাদন করা হবে। এ প্রকল্পের আওতায় পাটচাষীদের মাঝে বিনামূল্যে পাটবীজ বিতরণসহ নানা সার এবং অর্থনৈতিক সহায়তাও দেয়া হবে। এর ফলে দেশে পাটের আবাদ বাড়বে।

যে কারণে কমতে পারে পাটের আবাদ: পাটচাষীরা জানান, অনেক জমি পতিত থাকলেও লোকসানের শংকায় তা আর এ বছর আবাদের আওতায় আনেননি। মেশিন দিয়ে পানি দিয়েও খরার কারণে কোন লাভ হয় না। আবার মেশিন দিয়ে পানি দিয়ে পাট আবাদ করেও পরে অতিবৃষ্টিতে চারাগাছ মরে গেছে। এরপর ছিল ছানা পোকা ও বিছা পোকার আক্রমন। এসব চাষীদের অভিযোগ, তাদের দুর্দিনে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদেরও পাশে পাননি। ফলে ক্ষেতের পাট বিনষ্ট হয়েছে পোকার আক্রমনে। এছাড়া পানির অভাবে পাট জাগ দিতেও কৃষকদের নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। কৃষি বিভাগ উদ্ভাবিত রিবন রেটিং পদ্ধতিতে কৃষকেরা পাট জাগ দিতে উৎসাহী নন। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, এতে পাটের রং আসে না। রিবন রেটিং পদ্ধতিতে জাগ দেয়া পাটের দামও পাওয়া যায় না। এছাড়া পাটখড়িও নষ্ট হয়ে যায়।

(এএনএইচ/এএস/সেপ্টেম্বর ০৪, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test