E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Walton New
Mobile Version

তিনমাসে ১৪৩ রোহিঙ্গার হাতে বাংলাদেশি পাসপোর্ট

২০২৪ ফেব্রুয়ারি ২৬ ১৬:৫০:৩৪
তিনমাসে ১৪৩ রোহিঙ্গার হাতে বাংলাদেশি পাসপোর্ট

স্টাফ রিপোর্টার : শক্তিশালী একটি প্রতারক চক্র গত তিন মাসে ১৪৩ রোহিঙ্গার হাতে বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরি করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, দেশের ভেতরে থাকা দাগি আসামি ও অপরাধীদেরও অবৈধভাবে ভুয়া জন্ম সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট বানিয়ে দিয়ে আসছিল এই চক্রটি।

দেশের ভেতরে নারীসহ সাধারণ পুরুষদের এনআইডি কার্ড সংগ্রহে সক্রিয় রয়েছে দালাল চক্রের একটি গ্রুপ। এরপর অন্যজনের নামে অবৈধভাবে তৈরি করা হয় এনআইডি কার্ড। বিপুল ডকুমেন্টস ও ডিভাইসসহ গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে রয়েছে, রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ, দালাল ও ২ আনসার সদস্যও।

চক্রটি তিনটি পর্যায়ে কাজ করে রোহিঙ্গা ও দাগি অপরাধীদের তৈরি করে দিচ্ছে ভুয়া পাসপোর্ট। প্রথমে ভূয়া জন্ম সনদ তৈরি। দ্বিতীয় পর্যায়ে জন্ম সদন দিয়ে এনআইডি কার্ড। এরপর তৃতীয় ধাপে ওই এনআইডি কার্ডের মাধ্যমে অবৈধভাবে তৈরি করা হচ্ছে রোহিঙ্গা নাগরিকসহ দাগি আসামিদের পাসপোর্ট।

মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শিশু, নারী ও পুরুষদের অবৈধভাবে জন্ম সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট বানিয়ে দেয়া শক্তিশালী একটি প্রতারক চক্রের ২৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ।

সোমবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।

গ্রেপ্তার রোহিঙ্গারা হলেন- উম্মে ছলিমা ওরফে ছমিরা, মরিজান ও রশিদুল। গ্রেপ্তার রোহিঙ্গা দালাল হলেন- আইয়ুব আলী ও মোস্তাকিম। দুই আনসার সদস্য হলেন- জামসেদুল ইসলাম ও মো. রায়হান। গ্রেপ্তার বাঙালি দালাল- রাজু শেখ, শাওন হোসেন ওরফে নিলয়, ফিরোজ হোসেন, মো. তুষার মিয়া। আগারগা, মোহাম্মদপুর, উত্তরাতে কম্পিউটারের দোকান খুলে এ কাজে লিপ্ত গ্রেপ্তার অপর দালালরা হলেন- মো. শাহজাহান শেখ, মো. শরিফুল আলম, জোবায়ের মোল্লা, শিমুল শেখ, আহমেদ হোসেন, মো. মাসুদ আলম, মো. আব্দুল আলিম, মো. মাসুদ রানা, ফজলে রাব্বি শাওন, রজব কুমার দাস দীপ্ত, আল-আমিন, মো. সোহাগ। গ্রেপ্তার আসামিদের হেফাজত থেকে মোট ১৭ টি পাসপোর্ট, ১৩ টি এনআইডি, ৫টি কম্পিউটার, ৩টি প্রিন্টার, ২৪টি মোবাইল ফোন এবং পাসপোর্ট তৈরির সংশ্লিষ্ট শত শত দলিলপত্র জব্দ করা হয়।

ডিএমপি অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের সাদিয়া সুলতানা সাথি একজন গৃহিণী। তার পাসপোর্ট নেই, বিদেশ যাবার কোনো স্বপ্ন নেই তার। দালাল চক্রটি গৃহিণী সাদিয়া সুলতানাকে টার্গেট করে তার এনআইডি কার্ড সংগ্রহ করে। পরে তার ছবি, ঠিকানা ও এনআইডি কার্ড ব্যবহার করে কক্সবাজারে থাকা উম্মে ছলিমার নামে রোহিঙ্গা নারীর পাসপোর্ট তৈরি দেয় দালাল চক্র। সাদিয়া সুলতানার মতো সাধারণ নারী ও পুরুষদের এনআইডি কার্ড সংগ্রহ করে গত তিন মাসে ১৪৩ জন রোহিঙ্গা নাগরিককে ভুয়া পাসপোর্ট তৈরি করে দেয় এই চক্রের সদস্যরা।

হারুন অর রশীদ বলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের একাধিক টিম রাজধানীর আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী ও বাড্ডায় ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বিপুল পরিমাণ পাসপোর্ট সংক্রান্ত ডকুমেন্টস, পাসপোর্ট এবং কম্পিউটারসহ ৩ রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষ, ১০ জন বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করে। তাদের দেয়া তথ্য সংগৃহীত ডকুমেন্টস বিশ্লেষণ করে ২৫ ফেব্রুয়ারি দিনে ও রাতে কক্সবাজার, টাঙ্গাইল এবং ঢাকায় ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে দুই আনসার সদস্যসহ রোহিঙ্গা ও বাঙালি দালাল চক্রের ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তিনি বলেন, গ্রেপ্তার চক্রটির একটি দল কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি থেকে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের সংগ্রহ করে ঢাকায় নিয়ে আসে। আরেকটি দল এদের জন্য জন্ম সনদ, এনআইডি বানিয়ে দেয়। সর্বশেষে অন্য দলটি ঢাকাসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে আনসার সদস্যদের মাধ্যমে ব্যাংকে এক্সপ্রেস, সুপার এক্সপ্রেস ধরনের টাকা জমা দেয়া, বায়োমেট্রিক্স করা ও ছবি তুলার ব্যবস্থা করে দেয়।

ছয় ঘণ্টার মধ্যে জন্ম সনদের জন্য তারা ৫ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা নেয়। তিন দিনের মধ্যে এনআইডি করে নেয়ার জন্য ২৫ হাজার টাকা এবং পাসপোর্ট তৈরি করার জন্য ১ লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা নিয়ে থাকে বলে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছে।

হারুন অর রশীদ বলেন, গ্রেপ্তার দালালদের মোবাইলে শত শত পাসপোর্ট করে দেয়ার প্রাসঙ্গিক সফট ডকুমেন্টস, ডেলিভারি স্লিপ পাওয়া গিয়েছে। যার মধ্যে গত তিন মাসে রোহিঙ্গাদের জন্য করা ১৪৩ টি পাসপোর্ট ইতোমধ্যে তারা সরবরাহ করেছে। ২০১৯ সাল থেকে চক্রটি রোহিঙ্গাদের, বাংলাদেশী দাগি অপরাধীদেরকে ভিন্ন নাম ও ঠিকানায় হাজার হাজার পাসপোর্ট করে দিয়েছে বলে জানা গেছে।

তিনি বলেন, গ্রেপ্তাররা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, রংপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ ও বরিশাল জেলার ঠিকানা ব্যবহার করে জন্ম সনদ ও এনআইডি বানিয়ে তার ভিত্তিতে পাসপোর্ট বানিয়ে থাকে।

তিনি বলেন, প্রযুক্তি অনুশীলনে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ডাটা, ডিজিটাল জন্ম সনদ ডাটা, স্মার্ট এনআইডি ডাটা ব্যাংক আছে যেখানে বিভিন্ন বায়োমেট্রিক্স, ছবিসহ নানা তথ্য সংরক্ষিত। এ সকল তথ্য কোনরকম ভেরিফাই না করেই ইচ্ছামতো তৈরি করা কাগজপত্রের ভিত্তিতে পাসপোর্ট অফিসে যে কেউ দালালদের মাধ্যমে টাকা জমা দিতে, বায়োমেট্রিকস দিতে এবং পাসপোর্টের জন্য ছবি তুলতে পারে। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের স্মারক পাসপোর্ট তৈরির জন্য তাৎক্ষণিকভাবে রোহিঙ্গা ডাটা, ডিজিটাল জন্ম সনদ ডাটা এবং স্মার্ট এনআইডি ডাটা ভেরিফাই করলেই রোহিঙ্গাসহ নন-বাংলাদেশিদেরকে শনাক্ত করা সম্ভব।

পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে তো এসবি পুলিশ ভেরিফিকেশনের কাজ করে। তখন কেন ধরা পড়ে না? জানতে চাইলে হারুন বলেন, ধরা পড়বে কি করে? একজনের হাতে জন্ম সনদ, এনআইডি তুলে দেবার পর সে যখন জরুরি ভিত্তিতে পাসপোর্ট করতে দেবে তখন তো পুলিশ দেখে মোবাইল নাম্বার। সেই নাম্বারে যোগাযোগ করলে সে সব বলে দেয়, কারণ তাকে তো সব শেখানো হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ বর্তমান ঠিকাতে যায়। রোহিঙ্গা নাগরিক স্থায়ী ঠিকানা কক্সবাজার দিলেও বর্তমান ঠিকানা সে ব্যবহার করে।

পাসপোর্টসহ হাসপাতাল ও সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে আনসার সদস্যরা কাজ করছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় দালালদের সঙ্গে মিলে প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। আপনারা এবার দুই আনসার সদস্যকে গ্রেপ্তারও করেছেন। তাদের ব্যাপারে তদন্ত করবেন কিনা জানতে চাইলে হারুন বলেন, আরও কেউ জড়িত আছে কিনা তা তদন্ত করে দেখছি। বিষয়টি আমরা আনসারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো।

পাসপোর্ট জালিয়াতি কিংবা অবৈধভাবে পাসপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কেউ জড়িত থাকার তথ্য আপনারা পেয়েছেন কি-না জানতে চাইলে ডিএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার হারুন বলেন, বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি। আমার মনে হয় এভাবে হাজার হাজার পাসপোর্ট রোহিঙ্গারা নিয়ে যাচ্ছে, দাগি আসামিরা নিচ্ছে। অথচ কোনো ভেরিফিকেশন করা হয় না, তাদের ডাটাবেইজে তো দেশি নাগরিক ও রোহিঙ্গাদের সবার বিস্তারিত ডাটা রয়েছে।

দাগি আসামিদের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক দাগি আসামিও এভাবে পাসপোর্ট করেছে। তাদের নাম পরিচয় ও আমরা তদন্তের স্বার্থে জানাচ্ছি না। গ্রেপ্তারদের আদালতে সোপর্দ করে আবেদন করা হলে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে আরও যারা যারা জড়িত তাদের নাম পরিচয়ও বেড়িয়ে আসবে।

(ওএস/এসপি/ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২৪)

পাঠকের মতামত:

২৭ জুলাই ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test