E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুজাহিদ-সাকার মৃত্যু পরোয়ানা বৃহস্পতিবার

২০১৫ সেপ্টেম্বর ৩০ ২২:০১:২০
মুজাহিদ-সাকার মৃত্যু পরোয়ানা বৃহস্পতিবার

স্টাফ রিপোর্টার : জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরীর মৃত্যু পরোয়ানা জারি করা হবে বৃহস্পতিবার (১ অক্টোবর)

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত শীর্ষ এই দুই যুদ্ধাপরাধীর আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় গ্রহণের পর এ কথা জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সূত্র।

আইন অনুসারে বিচারিক আদালত ট্রাইব্যুনালের তিন বিচারপতি মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে কারাগার, স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠাবেন। এ পরোয়ানার ভিত্তিতে দেশের ফাঁসি কার্যকরে পরবর্তী প্রক্রিয়া শুরু করবে কারা কর্তৃপক্ষ।

বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে সাতটার দিকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে ট্রাইব্যুনালে পৌঁছে পূর্ণাঙ্গ রায় দু’টি। রায়ের অনুলিপিসহ অন্য কাগজপত্র পাঠান সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম। আপিল বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার মো. আবু তাহের ভূঁইয়াসহ কর্মকর্তারা সেগুলো নিয়ে যান।

গোছানো ও আনুষঙ্গিক কাজ শেষে আটটা ২৫ মিনিটে সেগুলো গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মো. শহীদুল আলম ঝিনুকের ব্যক্তিগত সহকারী জহিরুল ইসলাম জাহিদ।

বৃহস্পতিবার সকালে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক এবং বিচারিক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ সোহরাওয়ার্দী মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবেন বলে জানিয়েছেন রেজিস্ট্রার।

এর আগে বিকেলে মুজাহিদের ১৯১ পৃষ্ঠার এবং সাকা চৌধুরীর ২১৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ আপিল মামলার রায় প্রদানকারী চার বিচারপতির স্বাক্ষরের পর তা প্রকাশ করা হয়। অন্য বিচারপতিরা হচ্ছেন, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

গত ১৬ জুন একাত্তরের কিলিং স্কোয়াড আলবদর বাহিনীর প্রধান মুজাহিদ এবং ২৯ জুলাই চট্টগ্রাম অঞ্চলের নৃশংসতম মানবতাবিরোধী অপরাধের হোতা সাকা চৌধুরীর মামলার সংক্ষিপ্ত চূড়ান্ত রায় দেন আপিল বিভাগ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে চার সদস্যের একই আপিল বেঞ্চ পৃথক পৃথক এ রায় দেন।

ট্রাইব্যুনালের মৃত্যু পরোয়ানা জারির পর দেশের শীর্ষ দুই যুদ্ধাপরাধী মুজাহিদ-সাকা চৌধুরীর প্রাণদণ্ড কার্যকর প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাবে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তবে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর থেকেই ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া রাষ্ট্র এগিয়ে নিয়ে যাবে বলেও তিনি জানান।

বুধবার নিজ কার্যালয়ে ব্রিফিংয়ে তিনি জানান, ট্রাইব্যুনালের মৃত্যু পরোয়ানা জারির পর এ রায় কার্যকর করতে শেষ দু’টি ধাপ অতিক্রম করতে হবে।

দ্বিতীয় ধাপে বিধি মোতাবেক রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ (পুর্নবিবেচনা) করতে পারবেন আসামি ও রাষ্ট্র উভয়পক্ষই।

দু’জনের চূড়ান্ত রায় প্রকাশের পর পরই বুধবার বিকেলে তাদের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন জানিয়েছেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার পর তারা রিভিউ করবেন। তবে তার দাবি, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর থেকে নয়, তারা রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার পর থেকে রিভিউ করতে ১৫ দিনের সময় পাবেন।

মাহবুবে আলম বলেন, আইন অনুসারে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর থেকেই দণ্ড কার্যকরে উদ্যোগ নিতে পারবে রাষ্ট্র। আর আপিল বিভাগের দেওয়া সময় অনুসারে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের জন্য ১৫ দিন সময় পাবেন আসামিপক্ষ। যখনই পুনর্বিবেচনার আবেদন করবেন তারা, তখনই মৃত্যু পরোয়ানা ও দণ্ড কার্যকর প্রক্রিয়া স্থগিত থাকবে।

রিভিউ করার পর সর্বোচ্চ আদালতে শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তির পর সর্বোচ্চ দণ্ড বহাল থাকলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারবেন আসামি। প্রাণভিক্ষা না চাইলে সুবিধামতো সময়ে দণ্ড কার্যকর করবে রাষ্ট্র।

আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ
মানবতাবিরোধী অপরাধে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীন, বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি মুজিবুর রহমান মিয়ার সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ রায় দেন।

ওই বছরের ১১ আগস্ট ট্রাইব্যুনালের এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন তিনি। তবে সর্বোচ্চ সাজার প্রেক্ষিতে আপিল করেননি রাষ্ট্রপক্ষ।

গত ২৯ এপ্রিল থেকে আপিল মামলার শুনানি শুরু হয়ে ২৭ মে মোট নয় কার্যদিবসে শেষ হয়। গত ১৬ জুন মুজাহিদের আপিল খারিজ করে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে চূড়ান্ত রায় দেন আপিল বিভাগ।

চূড়ান্ত রায়ে ৬ নম্বর অভিযোগে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পেয়েছেন মুজাহিদ। এ অভিযোগে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটিতে (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব) থাকা নেতা হিসেবে গণহত্যা সংঘটিত করা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা, হত্যা, নির্যাতন, বিতাড়ন ইত্যাদির ঘটনার দায়ও প্রমাণিত হয়েছে তার বিরুদ্ধে।

তবে ১ নম্বর অভিযোগে শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে হত্যার দায়ে থেকে আপিল মামলার রায়ে খালাস পেয়েছেন মুজাহিদ। ট্রাইব্যুনাল এ অভিযোগে তাকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন। এ অভিযোগেও মুজাহিদের সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির দায় প্রমাণিত হয়েছিলো ট্রাইব্যুনালের রায়ে।

অন্যদিকে ৭ নম্বর অভিযোগে ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ ও গণহত্যার দায়ে মুজাহিদকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।

প্রমাণিত ১ নম্বর অভিযোগকে ৬ এর সঙ্গে সংযুক্ত করে এ দু’টি অভিযোগে সমন্বিতভাবে ও ৭ নম্বর অভিযোগে মুজাহিদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। আপিল বিভাগ ১ ও ৬ নম্বর অভিযোগকে আলাদা করেই চূড়ান্ত রায় দেন।

৫ নম্বর অভিযোগে ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদসহ কয়েকজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন এবং ৩ নম্বর অভিযোগে ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামট এলাকার (রথখোলা) মৃত রমেশ চন্দ্র নাথের পুত্র রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে আটক ও নির্যাতনের দায়ে ৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয় ট্রাইব্যুনাল থেকে। প্রমাণিত না হওয়া ২ ও ৪ নম্বর অভিযোগে খালাস পান মুজাহিদ। ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে একমত হয়ে এ চার অভিযোগের দণ্ড বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।

প্রমাণিত না হওয়া ২ নম্বর অভিযোগে ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন থানায় বিভিন্ন গ্রামে হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও গণহত্যার অভিযোগ এবং ৪ নম্বর অভিযোগে কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামট এলাকার মো. আবু ইউসুফ পাখিকে আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছিল।

সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরী
মানবতাবিরোধী অপরাধে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য সাকা চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ রায় দেন।

একই বছরের ২৯ অক্টোবর খালাস চেয়ে আপিল বিভাগে আপিল করেন সাকা চৌধুরী। তবে সর্বোচ্চ সাজা হওয়ায় আপিল করেননি রাষ্ট্রপক্ষ।

গত ১৬ জুন শুরু হয়ে ১৩ কার্যদিবসে আপিল শুনানি শেষ হয় গত ৭ জুলাই। ২৯ জুলাই সাকা চৌধুরীর ফাঁসির চূড়ান্ত রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত।

এ রায়ে ট্রাইব্যুনাল সাকা চৌধুরীকে অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যাসহ যে চার হত্যা-গণহত্যার দায়ে সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছিলেন সেগুলোর সাজাই বহাল রাখেন সর্বোচ্চ আদালত। ফলে চূড়ান্ত রায়েও অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা (৩ নম্বর অভিযোগ), রাউজানের সুলতানপুর গ্রামে তিনজনকে গণহত্যা (৫ নম্বর অভিযোগ), রাউজানের ঊনসত্তরপাড়ায় ৫০-৫৫ জনকে গণহত্যা (৬ নম্বর অভিযোগ) এবং চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোজাফফর আহম্মদ ও তার ছেলে শেখ আলমগীরকে হত্যার(৮ নম্বর অভিযোগ) দায়ে ফাঁসির আদেশ হয়েছে তার।

অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত নয়টি অভিযোগের মধ্যে অন্য তিনটি অভিযোগের প্রত্যেকটিতে ২০ বছর এবং আরো দু’টি অভিযোগের প্রতিটিতে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিল তাকে। সব মিলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি মোট ৭০ বছরের কারাদণ্ড পান তিনি। এর মধ্যে শুধু রাউজানের সতীশ চন্দ্র পালিতকে হত্যার (৭ নম্বর অভিযোগ) দায় থেকে আপিল বিভাগের রায়ে খালাস পেয়েছেন তিনি, যে অভিযোগে তাকে ২০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। এর ফলে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি মোট ৫০ বছরের কারাদণ্ড বহাল রয়েছে।

বহাল থাকা অন্য চার অভিযোগের দণ্ডাদেশের মধ্যে রাউজানের গহিরা গ্রামের হিন্দুপাড়ায় গণহত্যা(২ নম্বর অভিযোগ) ও জগৎমল্লপাড়ায় ৩২ জনকে গণহত্যার(৪ নম্বর অভিযোগ) দায়ে ২০ বছর করে ৪০ বছর এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ, সিরাজ ও ওয়াহেদ ওরফে ঝুনু পাগলাকে অপহরণ করে নির্যাতন(১৭ নম্বর অভিযোগ) এবং চান্দগাঁওয়ের সালেহউদ্দিনকে অপহরণ করে সাকা চৌধুরীর পারিবারিক বাসভবন গুডসহিলে নিয়ে নির্যাতনের (১৮ নম্বর অভিযোগ) দায়ে ৫ বছর করে আরো ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে সাকাকে।

ট্রাইব্যুনালে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ২৩টি অভিযোগের মধ্যে ১৭টির পক্ষে সাক্ষী হাজির করেন রাষ্ট্রপক্ষ। সেগুলোর মধ্যে দোষী সাব্যস্ত করা নয়টি বাদে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়া বাকি আটটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়। এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষ যে ছয়টি অভিযোগের পক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করেননি সেগুলো থেকেও সাকা চৌধুরীকে খালাস দেওয়া হয়। এ ১৪টি অভিযোগের বিষয়েও ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।

(ওএস/অ/সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

১৮ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test