E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ফরিদপুরে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই নিয়ে নয়-ছয়ের অভিযোগ!

২০১৭ মে ০৬ ২০:১৬:৪৫
ফরিদপুরে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই নিয়ে নয়-ছয়ের অভিযোগ!

বিশেষ প্রতিনিধি, ফরিদপুর : ফরিদপুর জেলার সদর উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই নিয়ে নয়-ছয়ের অভিযোগ উঠেছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু ফরিদপুরের রাজনীতির নিয়ন্ত্রকের পছন্দ নয়, এমন অনেককে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা নন, কিন্তু প্রভাবশালী মহলটির ইচ্ছায় অনেককে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকায় নাম সংযোজনের সুপারিশ করা হয়েছে।

জানা যায়, নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তি এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত, এমনকি ভাতাভোগী মুক্তিযোদ্ধাদের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ দেয়ার জন্য দেশের সব এলাকা থেকে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল তথা জামুকা ও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে অনেক দরখাস্ত জমা পড়েছে। সেই প্রেক্ষিতে ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালযের সিদ্ধান্তে দেশব্যাপি ৭ সদস্য বিশিষ্ট উপজেলা ভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি গঠিত হয়। জামুকার নির্দেশে গত ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শুরু হয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ফরিদপুর সদরেও ৭ সদস্যের যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হয়। পদাধিকার বলে ফরিদপুর সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম ওই কমিটির সদস্য সচিব হন। অন্য ৬ মুক্তিযোদ্ধা সদস্য হলেন আব্দুস সালাম লাল, সামসুদ্দিন ফকির, সালাউদ্দিন আহমেদ, মোকাররম হসেন, খলিলুর রহমান ও নাজমুল হাসান নসরু।

ফরিদপুর সদর উপজেলায় গত ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৭ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য পর্যায়ক্রমে এলাকাভিত্তিক নতুন আবেদনকারীদের কাগজ-পত্র পরীক্ষা ও শুনানী গ্রহণ করা হয়। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি চলমান তালিকার প্রায় ৪০০ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ৬৮ জন মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে কয়েকখানা দরখাস্তে আনীত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগ বিষয়ে শুনানী গ্রহণ করা হয়। দরখাস্তসমূহের মধ্যে বিভিন্ন অভিযোগ সম্বলিত একখানা দরখাস্ত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে সুপারিশসহ জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল হয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সচিব বরাবর প্রেরণ করা হয়। ওই দরখাস্তে অভিযুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৩২ জন ও অভিযোগকারী হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন ৬ জন। ওই দরখাস্তে যাঁদের ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়, তাদের মধ্যে ফরিদপুর জেলার বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মহিউদ্দিন মোল্লা, শামসুল হক ভোলা মাস্টার, আব্দুর রহমান, আমিনুদ্দিন আহম্মদ প্রমুখের নাম রয়েছে। এমনকি ওই অভিযোগ পত্রে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামীলীগ নেতা ও ফরিদপুর সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এডভোকেট শামসুল হক ভোলা মাস্টারকে শুধু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাই বলা হয়নি, বলা হয়েছে স্বাধীনতা বিরোধীও। ওই দরখাস্তে কথিত স্বাক্ষরদানকারী হলেন আব্দুস সালাম সেক,আব্দুল হালিম, আব্দুল ওয়াহেদ, আব্দুল মালেক, খলিলুর রহমান ও মোহাম্মদ শাহজাহান। পরে অবশ্য তারা প্রত্যেকেই ওই অভিযোগপত্র দায়েরের কথা অস্বীকার করেন। বাকি ৩৬ জন মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ সম্বলিত বেশ কয়েকখানা দরখাস্ত উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটির সচিব সমীপে স্থানীয় ভাবে দাখিল করা হয়। কোন কোন অভিযুক্তের নাম একাধিক দরখাস্তেও থাকে। এমনকি যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য আব্দুস সামসুদ্দিন ফকিরের বিরুদ্ধেও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগ উত্থাপিত হয়।

মজার বিষয় হল, প্রকাশ্য যাচাই-বাছাই কালে সকল অভিযোগপত্রের সকল স্বাক্ষরকারীই অভিযোগপত্রে স্বাক্ষর করার কথা অস্বীকার করেন। এমনকি ঢাকা থেকে আসা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল ও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ সম্বলিত অভিযোগপত্রে কথিত স্বাক্ষরকারীরাও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের কথা অস্বীকার করেন। এমনকি এসব অভিযোগপত্রে যাদের স্বাক্ষর দেখা যায় তাদের অধিকাংশই যাচাই-বাছাই কমিটির সচিবের কাছে পাল্টা দরখাস্ত দিয়ে একথা বলেছেন যে, তারা কোন মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগপত্র দাখিল করেননি। তাদের নাম ব্যবহার করে কোন স্বার্থান্বেষী মহল এ কাজ করে থাকতে পারে। তারপরও অভিযুক্তদের কাগজ-পত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কমিটির সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা সালাউদ্দিন আহমেদ ও সচিব জহিরুল ইসলাম মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্বস্ত করে বলেন, সব অভিযোগ ভুয়া, সবাই নিশ্চিন্ত থাকেন। কারণ অভিযোগগুলি আমলে নেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু এরই মধ্যে কতিপয় মুক্তিযোদ্ধার পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য হাই কোর্ট বিভাগে যাচাই-বাছাই কার্যক্রমকে চ্যালেঞ্জ করে একটি ‘রিট’ দায়ের হলে মহামান্য হাইকোর্টের আদেশে যাচাই-বাছাই কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করা হয়। ফরিদপুর সদর উপজেলার যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শেষ হওয়া সত্বেও মহামান্য হাইকোর্টের ওই নিষেধাধাজ্ঞার প্রেক্ষিতে কোন ফলাফল ঘোষণা না করে সকল কার্যক্রম ফাইলবন্দি করে রাখা হয়। এমনটি সারা বাংলাদেশের অনেক উপজেলার ক্ষেত্রেই ঘটে।

ফরিদপুর সদর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শেষ হয় গত ২৮ ফেব্রুয়ারি। ইতোমধ্যে দুই মাস সময় পার হয়ে গেছে। যাচাই-বাছাই কার্যক্রম সম্পন্নকারী ফরিদপুর সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তথা যাচাই-বাছাই কমিটির সচিব জহিরুল ইসলাম মহোদয় বদলি হয়ে গেছেন। মহামান্য হাই কোর্টে দায়েরকৃত রিট খারিজ হওয়ায় আগের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়েছে। সম্প্রতি অভিযুক্ত মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্বস্তসুত্রে জানতে পেরেছেন, ফরিদপুর সদর উপজেলার যাচাই-বাছাই কমিটি অধিকাংশ অভিযুক্তদেরই অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেন নাই। উপরন্তু ৩৪ জন নতুন আবেদনকারীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করবার সুপারিশ করেছেন, যাদের বেশীরভাগই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। আর এই ঘটনায় ফরিদপুর সদর উপজেলার অনেক ত্যাগী ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইয়ের প্রণেতা আব্দুর রহমান বলেন, আমরা আশঙ্কা করছি ,ফরিদপুর সদরে রাজনৈতিক বিবেচনায় ক্ষমতাধরদের ইচ্ছা-অনিচ্ছারই প্রতিফলন ঘটবে মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন তালিকায়। আর সেটা করা হলে আমরা আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হবো।

(পিএস/এএস/মে ০৬, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test