E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বালি : পর্ব-২

সী ফুডের শহরের অলিগলিতে

২০১৯ মার্চ ০১ ১৬:০০:০৫
সী ফুডের শহরের অলিগলিতে

মুহাম্মদ সেলিম হক : কুটাবিচ, বালির একেবারে ব্যস্ত একটি সমুদ্র তটের বিচ। তথ্যমতে ৫,৭৮০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বালির আয়তন। জেনেছি ইন্দোনেশিয়ায় ৩৪টি প্রদেশ রয়েছে। তার মধ্যে বালি এক সময় কৃষিতে নিভর্র ছিলো। ছিল দারিদ্রতার সাথে গড়াগড়ি ও সম্পৃক্ত। অথচ পর্যটনই একমাত্র বদলে দিলো এদের জীবন যাত্রার মান। উন্নত করেছে দেশ।

সে দেশের হিসাব মতে, প্রতিবছর ১২ লাখেরও উপরে থাকে বিদেশী ট্যুরিস্টের আসা যাওয়া। এদের পদচারণে বদলে যায় পুরো বালি। ইন্দোনেশিয়ার ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে ধনীর কাতারে শীর্ষে রয়েছে বালি। এখনো কৃষিকাজ রয়েছে। তবে আগের মতো নেই। পুরো প্রদেশের আশেপাশ বিচে মোড়ানো।

বীচগুলির সৌন্দর্যময় একটা অন্যটার চেয়ে ভিন্ন মনোমুগ্ধকর। মনেহয় সেভাবেই তৈরী করেছে। প্রকৃতি আর মানুষের সংমিশ্রণে তৈরি নিঁখুত শহর। রাজধানীর নাম ডেনপাসা। কুটাবিচ থেকে ৫০ হাজার রুপিয়া দিয়ে মুল শহরে যেতে হয়। শহরে বাস/লরি নেই তেমন। ভরসা একমাত্র স্কুটি আর নীল রংয়ের টেক্সী। দরাদরি করলে ভাড়া কমবে। বেঁচে যাবে বাড়তি রুপিয়া।

পরিস্কার পরিচন্নতা দেখে পর্যটকদের মনে একটা মাদকের মতো নেশার তাড়না জাগাবে মনেপ্রাণে। আপনাকে আবেগ প্রবণ করিয়ে হৃদয় ভরিয়ে দিবে অন্য এক সুখনাভূতিতে। সবুজায়ন আর কালো কার্পেটিং পিচ ঢালায় দেখে। মনে হবে যেন কোন অটোমেশিনের শহর। পরিকল্পনায় আর মানুষের আন্তরিকতা মনে পড়ে গেলো বাংলাদেশের কক্সবাজার শহরের কথা। কত পিছনের পথে আমরা। ভটভটি আর টমটমের অত্যাচারে অতিষ্ট পর্যটনের নগরী কক্সবাজার। যেন কেহ এগিয়ে আসছেনা।

অথচ এখানে গাড়িগুলো আপনাকে দেখে থেমে যাবে রাস্তা পারাপারের সময় দেবে। আগে জীবন বাঁচাবে তারপর গন্তব্যে ছুটে চলা তাদের। ড্রাইবার আন্তরিকতায় হাসি মাখা চেহারায় বলবে আপনি যান। অচেনা বালির সকালটা ঝলমলো রোদের কড়া বার্তা বলে দেয় এখানে শীত নেই। সারা বছর আবহাওয়া গরম আর বৃষ্টির দৌলাচলের মাঝে জীবন কাটে বালির অধিবাসীদের।

অজানা বালিকে জানার সন্ধানে সকালে পথে প্রান্তে ছুটে চললাম। এখানে রাস্তায় বের হলে আপনাকে ঘিরে ধরবে স্কুটি আরোহনকারীরা। বালিতে মানুষের চেয়ে বাইক বেশি। দেখে মনে হলো জীবনে কিছু থাকুক বা না থাককু ইন্দোনেশিয়ার প্রতিটি নাগরিকের কাছে একটা বাইক থাকা চাই। এখানে স্কুটি ভাড়া দেওয়া হয়। বালির দ্বিতীয় দিনে আমাদের টেনশনে ভরপুর যার কারণ সে দেশের মোবাইল সিমকার্ড।

যোগাযোগ নেই বাড়ির সাথে। পথে হাঁটতে ছোট মোবাইলের দোকান মিলে তবে আগন্তুক ট্যুরিস্টদের দাম বাড়িয়ে নেয় দোকানিরা। বাংলাদেশী মুদ্রায় এক হাজার টাকা হওয়াতে, কিনতে সাহস কুলায়নি। সস্তার পাবো এমন আশায় পথ চলতে লাগলাম আর শহর দেখতে শুরু করলাম।

কিছুদুর যেতেই নজরে পড়ল একটি শপিংমল। তাতে একটি কোম্পানি সিমকার্ড বিক্রি করছে রিসেপশনে বসা মুসলিম মহিলা। মুসলিম জেনে সম্ভাষণে সালাম দিলাম, মহিলাটা তা শুনে একটা হাসি দিলেন। তার কাছে কয়েকটি প্যাকেজের সিমকার্ড পেলাম। সর্বনিম্ন ছিলো ১ লাখ ৫ হাজার রুপিয়া। সাত দিন চলবে সাথে ৩ জিবি ডাটা পাবো ফ্রিতে।

ছবি আর পাসপোর্ট ছাড়া মিলে গেল মোবাইল সীমকার্ড। যা অন্য দেশে কল্পনা করা যায়। তবে ইন্দোনেশিয়ার বালিতেই সম্ভব। সীমকার্ড পাওয়াতে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ এলো। কেন না বাড়ির সাথে দারুণ একটি সংযোগ হবে। সাথে প্রিয় মানুষদের সঙ্গে কথা ও গল্প হবে।

আমাদের হোটেল থেকে বীচ বেশি দুর নয়। দুরত্ব মনেহয় ৩ মিনিটের মতো রাস্তা। তবে নতুন হওয়াতে ৩০ মিনিটে হেঁটে কুটাবিচের সাগর পাড়ে গেলাম। সাগর পাড়ে গিয়ে অবাক হলাম! টেউ আছে। আছে অল্পস্বল্প ট্যুরিস্টও। নেই কেবল জৌলুশ। ময়লা আবর্জনায় ভরা সাগর পাড়। যেন শহরের সাথে আকাশ আর পাতাল। আমার সফর সঙ্গী সমীর বাবুর চেহারাটা কেমন মলিন হয়ে গেলো। আর বলতে লাগলো আমাদের কক্সবাজার এর চেয়ে কত ভালো। সে তুলনায় করতে ব্যস্ত তিনি।

হতাশার ভরা মন, শরীরটা হেলিয়ে বসে পড়লো সে। আনমনা সাগর দেখছেন। চোখের পলকে দুরে সাগর দিকে শব্দহীন কি জানি বলছে। ২০ হাজার রুপিয়ার বিনিময়ে একটি কোক আর দুটো আরএফএল মার্কা চেয়াওে বসে সমুদ্রজল দর্শন ৩০ মিনিটের। ভর দুপুর বেলা হাঁটছি আর ভাবছি এ বুঝি বালি! হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম আর একটি বীচ। নাম জার্মান বীচ। একটু ভিন্ন। আগে বলছি একেকটা একেক রকম। রিসোর্ট আছে। একেবারে সাগরের পাড় ঘেঁষা। ট্যুরিস্টের আগমণ টুইটুম্বর।

সন্ধ্যা হলে গোঁধুলীর আবীরের সাথে মিশে লালে লাল হয়ে ওঠে, আর ভেসে আসে রিসোর্ট থেকে সুরের মূর্ছনা। সাথে দেখা মিলবে গুষ্ঠিমরা রায় এয়ারপোর্টের ফ্লাইট উঠানামার দৃশ্য। যেন হাতের মুঠোয় বিমান। কি অপূর্ব দৃশ্য! যেন স্বপ্ন দেখায় একটা কাব্যিময় জীবনের কথা।

প্রকৃতির উদারতার সাথে দ্বীপের মানুষের কত আদান প্রদান। চলতে চলতে চোখে পড়বে আপনার ইন্দোনেশিয়ার মেয়েদের নারকেল পাতার ব্যবহারের বিভিন্ন বাহারী কারুকার্য। শুরুতে যে হতাশ ছিলাম সে হতাশাটা কেটে খোলস মেলতে শুরু করে বালির সৌন্দর্য্যময় রুপ।

তবে বালির পযর্টন মৌসুম হলো মূলত জুন-জুলাই। কিছু ট্যুরিস্ট ঠাসাঠাসি হয় ডিসেম্বরে।
হোটেলে ফিরে ট্যুরিস্ট ম্যাপ সংগ্রহ করলাম। বাড়ির সাথে কথা হল। মনটা একটু সতেজ হয়ে উঠলো। পড়ন্ত বিকেল। সূর্য হেলে পড়ছে। আকাশে মেঘের আনাঘোনা। রাতে বৃষ্টি নামবে মনেহয়। হালকা ঠান্ডা বাতাস। এটা নাকি প্রতিদিন হয়। এখানে সন্ধ্যা নামে ৭টার চেয়ে বেশি সময় নিয়ে। ঘন্টা তিনেক সময় কাটনোর উপায় খুজঁতে লাগলাম।

এরমধ্যে হোটেলে ওডি নামে এক তরুণের সাথে ১দিনে একটু ভাব তৈরী হল। সে জানাল হাফবেলা গাড়ি ভাড়া নেয়া যায়। প্রতিঘন্টার ভাড়া ৫০ হাজার রুপিয়া। শহরের ভেতর ঘুরাঘুরির অনেক অফার রয়েছে। ২ লাখ ৫০ হাজার রুপিয়া গাড়ি ভাড়া করলাম। বালির গাড়ি গুলো পায়জেরো স্টাইলের। একেবারে নতুন। রাস্তায় ভাঙ্গা চূড়া গাড়ি দেখা বড়ই দূূর্লভ। তেলের দাম বাংলাদেশের মতো। প্রতি ডিজেল লিটার ৬৩ টাকা প্রায়। উঠানামা নেই সরকার কতৃক নির্ধারত মূল্যে।

বালি শহরের সবচেয়ে উচু স্টায়ার্চু শিব’কে দেখতে বের হলাম। স্বগৌরবে একটা ইতিহাস নিয়ে তিনি সবার উপরে। জায়গাটা বালির সাংস্কৃতিক বা ক্যালচারাল নামে পরিচিত। সন্ধ্যা হলে এখানে জমে ওঠে পাহাড়ের সাথে লাইটের বাহারি রঙের খেলা। তবে টিকেটের দাম বাড়তি। বিদেশীদের জন্য জনপ্রতি ১ লাখ ২৫ হাজার রুপিয়া।

টিকেট এর দাম দেখে আমি থমকে দাড়ালাম সমীর বাবু সাহস দিলো। আর বলল এতদুর আসলাম টাকার কথা ভেবে লাভ নেই। সাথে একটি ফ্রি জুস মিলবে অভিজতা রেস্টুরেন্ট এ। ফলের জুস খেতে খেতে আপনি পাহাড়ের চূড়ায় দেখতে পারেন। বালির সাগর আর সবুজের আবরণ মিলে একাকার। যেন কক্সবাজারের ইনানী পাহাড় আর সমুদ্র দর্শন।

তবে তার আগে আপনাকে প্রবেশের পর উপভোগ করানো হবে বালির সংস্কৃতি। ঐতিহ্যের চাপ আর আধুনিকতার বাইরে এদের ‘কেচাচ ডেন্স’ সময় নিয়ে দেখলে ভালো লাগবে আপনার ও। শুরুটা একটু একগুয়েমি। সে আদিকালের পোশাকে আর যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সুরে সন্ধ্যাটা প্রাণময় হয়ে ওঠে।

আপনি যদি ফ্রেশ সী-ফুড খেতে চান ‘জিবরান’ বীচে যেতে পারেন। প্রবেশে টিকেট লাগবে না একদম ফ্রি। তবে এখানের ফুড খুবই দাম। রাতে ডিনার জনপ্রতি ৫ লাখ করে পড়বে। রাতে এখানে খুবই জমে উঠে। অন্ধকার সাগরের সাঁ সাঁ শব্দ। আর সাথে জোরে জোরে বাতাস। সাথে বালির পুরানো দিনের নিজস্ব গান।

রাত ১০টা পর্যন্ত এখানে চলে গান আর খাবার। খাবারের দাম দেখে না খেয়ে চলে আসার উপক্রম। খাবারের স্বাদ আমাদের তেমন ভালো লাগে না। এদের খাবারের গন্ধটা কেমন যেন বিশ্রি নাকে সহ্য হয়না। কেমন জানি খাবারের টেবিলে বিচিত্র সব মাছ...

লেখক : সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও সংগঠক, কর্ণফুলী, চট্টগ্রাম।

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test