E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

মেডিকেলে চান্স পেয়েও প্রান্তির পড়াশোনার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় বাবা-মা

২০২৫ জানুয়ারি ২৬ ১৯:১৮:৫৯
মেডিকেলে চান্স পেয়েও প্রান্তির পড়াশোনার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় বাবা-মা

দিলীপ চন্দ, ফরিদপুর : দারিদ্র্যকে জয় করে প্রান্তি বিশ্বাস মেডিকেল ভর্তি যুদ্ধে অংশ নিয়ে চলতি বছর সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। তার বাবা রমেন কুমার বিশ্বাস কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন।

মা চঞ্চলা বিশ্বাস বাড়িতে মুড়ি ভেজে বাজারের দোকান দোকানে বিক্রি করেন। সামান্য আয়ে কোনোরকম চলে পরিবারটির জীবনযাপন।

রমেন-চঞ্চলা দম্পতির মেয়ে প্রান্তি বিশ্বাস ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন, এ খবরে তাদের বাড়িতে এলাকাবাসীর উপস্থিতি বুঝিয়ে দেয় সফলতা সবার জন্য আনন্দের।কিন্তু ভর্তি ও পড়ালেখা নিয়ে তার মা-বাবা দুশ্চিন্তার শেষ নেই।

মেডিকেল কলেজে পড়াশোনার খরচ কীভাবে পূরণ করবে সে বিষয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে প্রান্তির মায়ের কপালে।

প্রান্তির বাবা-মা দুইজনই নাম সই ছাড়া তেমন কোনো শিক্ষার যোগ্যতা নেই তাদের।

জানা যায়,প্রান্তি বিশ্বাস দুই ভাই-বোনের মধ্যে ছোট। তার ভাই রাহুল বিশ্বাস একটি বেসরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ডিপ্লোমা পাস করে এখন কর্মহীন অবস্থায় চাকরি খুঁজছেন। বাবা পরিবারের অভিভাবক হলেও মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রান্তি আজকে ভর্তি যুদ্ধে সাফল্য পেয়েছেন বলে পরিবার সূত্রে জানা গেছে।
ফরিদপুর সদর উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের হাট গোবিন্দপুর উত্তরপাড়া গ্রামের মেয়ে প্রান্তি বিশ্বাস।

প্রান্তিদের বাড়িতে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ফরিদপুর পৌরসভার সীমান্তবর্তী হাট গোবিন্দপুর বাজারের পূর্বদিকে সদর উপজেলার কানাইপুর-খলিলপুর গ্রামীণ সড়কের ধারে দুই শতাংশ জমির ওপর নির্মিত সেমি পাকা (প্লাস্টারবিহীন) বাড়িটি। ঘরটি ইটের হলেও মেঝে কাঁচা। দরজা-জানালা পাটখড়ি দিয়ে আটকানো। পাশেই রয়েছে ভাঙাচোরা একটা রান্নাঘর।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, তিনকক্ষের এই ইটের ঘরটি প্রান্তির দাদু(মায়ের বাবা) তাদের করে দেন। তার দাদু হঠাৎ মারা যাওয়ায় বাড়ির কাজটি শেষ হয়নি। এরপর আর ঘরের কাজ এগিয়ে নিতে পারেননি প্রান্তির বাবা রমেন বিশ্বাস। তখন থেকেই অসমাপ্ত এই ঘরে বসবাস করছেন চার সদস্যের পরিবারটি।

প্রান্তি বিশ্বাস স্থানীয় হাটগোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি থেকে জিপিএ-৫, কানাইপুর বেগম রোকেয়া কিশলয় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণি থেকে জিপিএ-৫ ও একই বিদ্যালয় থেকে ২০২২ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ লাভ করে ২০২৪ সালে ফরিদপুর সরকারি সারদা সুন্দরী কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন।

প্রান্তি বিশ্বাস জানান, পঞ্চম শ্রেণি থেকে শুরু করে এইচএসসি পর্যন্ত সব পরীক্ষায় আমি জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছি। অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও কোনো সময় খেয়ে না খেয়ে স্কুল কলেজে গিয়েছি। ভালো কোনো ড্রেস পরতে পারিনি।

আবেগপ্রবণ হয়ে আরো বলেন, আমার মা সব সময় আমাকে সাহস উৎসাহ দিয়েছেন। আর হাইস্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত অর্থনৈতিক সাপোর্ট দিয়েছেন আমার প্রধান শিক্ষক চঞ্চল স্যার। তবে আমার ইচ্ছা ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার। কিন্তু ঢাকায় গিয়ে কোচিং করার সামর্থ্য না থাকায় ওই পথ থেকে ফিরে আসি। তারপর থেকে মেডিকেলে পড়ার প্রস্তুতি শুরু করি। আমি ডাক্তার হয়ে এলাকার গরিব মানুষ ও গ্রামবাসীদের সেবা করতে চাই। যেহেতু আমি গবিব মানুষের মেয়ে, আমি গরিবের মর্ম বুঝি!

মেয়ের সাফল্য দেখে মা চঞ্চলা বিশ্বাস একবার হাসছেন, একবার কাঁদছেন। একপর্যায়ে তিনি বলেন, মেয়ে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েছে। দিনমজুর স্বামী সামান্য কামাই আর আমি মুড়ি ভেঁজে বিক্রি করে কোনোভাবে মেয়ের পড়ালেখার খরচ চালিয়েছি। স্কুলে যাওয়ার সময় ছেলে-মেয়ের মুখে আমি গরম ভাত দিতে পারিনি, এই দুঃখে আমার বুক ফেটে যায়।

তিনি আরো বলেন, মেয়ের শিক্ষকরা সব রকম সহযোগিতা করেছেন। শুনতেছি ডাক্তারি পড়ায় অনেক টাকা লাগে। তিনবেলা খেয়ে বেঁচে থাকায় কষ্ট হচ্ছে। আবার এর মধ্যে ঋণ নিয়ে দেনায় রইছি। মেয়ের পড়ালেখার চিন্তায় ঘুম আসে না।

প্রতিবেশী সম্পর্কে প্রান্তি বিশ্বাসের চাচা শুশান্ত বিশ্বাস বলেন, প্রান্তির বাবা কাঠমিস্ত্রি কাজ করতে সকালে বের হয়ে রাতে বাড়ি ফিরে। তার মাও চুলায় মুড়ি ভেঁজে টাকা জোগাড় করে মেয়েকে পড়ালেখার খরচ চালায়। শুরু থেকেই অনেক কষ্টের মধ্যে মেয়েটি সাফল্য পেয়েছে।

ঝুনু বিশ্বাস নামে অপর প্রতিবেশী বলেন, প্রান্তি ছোটবেলা থেকে পড়ালেখায় ভালো ছিল। ছেলে-মেয়েকে পড়াতে গিয়ে ওর মা অনেক ঋণ হয়ে গেছে।

কানাইপুর বেগম রোকেয়া কিশলয় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চঞ্চল দত্ত জানান, প্রান্তি ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির সময়ই মেধা তালিকায় ছিলেন। অষ্টম ও এসএসসিতে সে এ প্লাস প্রাপ্ত হয়। সে ভালো ফুটবলও খেলতো। কয়েক বার জেলা ও বিভাগীয় পুরস্কার পেয়েছে। সে একজন অদম্য মেধাবী, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় সাফল্য পেয়েছে। এজন্য আমরা গর্বিত।

এসএসসির পর থেকে পড়ালেখায় যাতে প্রান্তির কোনো সমস্যা না হয় জানিয়ে প্রধান শিক্ষক বলেন, প্রান্তির এইচএসসিতে পড়ার সময় হোস্টেলের খরচের জন্য বিকাশের দোকানে অগ্রিম টাকা রাখা হতো। যাতে তার পড়ালেখায় কোনো চাপ না পড়ে। সময়মতো বিকাশের দোকান থেকে কলেজে তার খরচ চলে যেত। আমরা আশাবাদী প্রান্তি ডাক্তার হয়ে গরিব অসহায় মানুষের সেবা করবে।

প্রসঙ্গত, গত ১৭ জানুয়ারি সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় ৬০ হাজার ৯৫ জন উত্তীর্ণ হয়। এর মধ্যে প্রান্তি বিশ্বাস ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পান।

(ডিসিপি/এএস/জানুয়ারি ২৬, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test