স্টাফ রিপোর্টার, বান্দরবান : কাটা হচ্ছে পাহাড়ী টিলা। ধ্বংস হচ্ছে বনাঞ্চল। আর হুমকিতে পড়ছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। কিন্তু তারপরও কিছুতেই থামছেনা পাহাড় খেকো চক্র। এখন ঘুমধুম জুড়ে দিন দুপুরেই দেদারছে চলছে পাহাড় কাটা। এমন দৃশ্যই চোখে পড়ছে পাহাড়ী এলাকা গুলোতে।

প্রভাবশালী চক্রের এমন বেপরোয়া মনোভাবে বরং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। কেউ কেউ পাহাড় কেটে পাদদেশে বসতঘর বানাচ্ছেন। অনেকেই মাটি বিক্রি করছেন। আবার কেউ কেউ তৈরী করছেন বাগান। রাস্তা তৈরী বা মেরামতের অজুহাতসহ নানা ছুতায় কায়দা কৌশলে কাটা হচ্ছে পাহাড়। কিছুতেই থামছেনা পাহাড় কাটা।

নির্বিকার প্রশাসন, স্থানীয় পুলিশ হতে নাইক্ষ্যংছড়ির সর্বোচ্চ পদে থাকা অনেকের পকেটে যাচ্ছে পাহাড় কাটার কমিশন এমনটি অভিযোগ স্বয়ং জনপ্রতিনিধিদের।

এ কারণে ঘুমধুমে দিন দিন ছোট হচ্ছে পাহাড়, কমছে বনাঞ্চলের আয়তন। একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে চালাচ্ছেন এই নিধনযজ্ঞ। পাহাড় কাটার এমন উৎসবে এ অঞ্চলের পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে কিছু প্রভাবশালীদের এমন খপ্পরে ধ্বংস হচ্ছে পাহাড়। তাদের লোলুপ দৃষ্টিতে অস্তিত্ব সংকটে এ ঘুমধুমের পাহাড়ী টিলা ও বনজ সম্পদ। হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ।

বান্দরবানের জেলার কয়েকটি উপজেলার পাহাড়ী এলাকায় এখন হরদম চলছে এমন বে-আইনী কর্মযজ্ঞ। প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে এলেই নির্বিচারে চলে পাহাড় কাটা। আর বর্ষা মৌসুমে ঘটে পাহাড় ধ্বসের ঘটনা। তখন পুরো বর্ষা মৌসুম জুড়ে থাকে প্রাণহানি ও সম্পদ হানির চরম উদ্বেগ উৎকন্ঠা। এনিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে হতাহতের ঘটনা এড়াতে তখন স্থানীয় প্রশাসন হন তটস্ত। কিন্তু এখন অবাধে পাহাড় কাটা বন্ধে কোন প্রতিকার না নিয়ে বরং তারা নীরব দর্শক। এমন অভিযোগ বাসিন্দাদের।

পাহাড় খেকো ওই চক্রটির এমন লোভাতুর মনোভাব আর প্রশাসনের রহস্যজনক নীরবতা পরিবেশের চরম বির্পযয় ডেকে আনছে। তবে কোন কোন উপজেলায় মাঝে মধ্যে প্রশাসন উদ্যোগী হন। চালান অভিযান। এতে কিছু দিনের জন্য পাহাড় কাটা বন্ধ হয়। অভিযান অব্যাহত না থাকায় কিছু দিন পর আবারো যেই সেই। স্থানীয়দের অভিযোগ কোথাও প্রশাসনকে লুকিয়ে। আবার অনেক স্থানে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই চলে এই বে-আইনী কর্মযজ্ঞ। এলাকাবাসী জানান ওই চক্র প্রথমে গাছ ও বনাঞ্চল উজাড় করে। তারপর সুযোগ বুঝে ওই ন্যাড়া পাহাড়ী টিলার মাটি কাটতে শুরু করে। সরজমিনে ওই সকল এলাকায় গেলে চোখে পড়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই অবাধে পাহাড় কেটে তা গাড়ি দিয়ে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার দৃশ্য।

অনুসন্ধানে জানা যায় ও উপজেলার এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, স্থানীয় থানা পুলিশের নাকের ডগায় বিনা বাধায় চলছে পাহাড় কাটা। ঘুমধুমে তুমব্র“ খাস পাহাড়, মাইল্যংতলী পাহাড়, আবুল ফরাজের পাহাড়, মৃত গাছ কালুর পাহাড়, মকছুদুর রহমানের পাহাড়, যুবদল নেতা গিয়াস উদ্দিন মামুনের পাহাড়, আলমের পাহাড়, নছরত আলীর পাহাড়, কথিত ছাত্রলীগ নেতা নুর হোসেন পাহাড় থেকে মাটি কাটা শুরু হয়ে বর্তমানে অব্যাহত আছে।

কিছু পাহাড় মাটি কেটে নাড়া করে ফেলছে। এর কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, ঘুমধুম পুলিশ ফাঁড়িকে অবৈধ পাহাড় কাটার দায়ে ভ‚মি খেকোরা সপ্তাহে ৩০ হাজার টাকা করে দেয়। মাসে দেয় ১ লক্ষ ২০ হাজার বছরে ১৪ লক্ষ ৪০ হাজার। এ যেন এক রমরমা ব্যবসা। এ বিষয়ে স্থানীয় সাংবাদিকেরা রিপোর্ট করতে গেলে নানা হুমকি পায় বলে ও জানা যায়।

বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যে দিবালোকে কাটা হচ্ছে পাহাড়ী টিলা। এসকল এলাকার কোন কোন স্থানে প্রকাশ্যে অবাধে চলছে পাহাড় কাটা। এমনটিই অভিযোগ স্থানীয় মানুষের।

নির্বিচারে পাহাড় কাটার বিষয়ে গণমাধ্যম সোচ্চার হলে প্রশাসনের তৎপরতায় মাস দিন তা বন্ধ থাকে। সম্প্রতি আবারো শুরু হয়েছে পাহাড় কাটা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান এখন নতুন করে কাটা হচ্ছে ঘুমধুমে পাহাড়ী টিলা টিলা’ ও উপজেলার বিভিন্ন ছোট বড় পাহাড়ী টিলার মাটি।

অভিযোগ উঠেছে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সরকার দলীয় কয়েজন নেতা পাহাড়ী টিলার মাটি কাটাচ্ছেন। জানা গেল শুষ্ক মৌসুমে পাহাড় কেটে মাটি বিক্রয় করা হয়। আর বর্ষা মৌসুমে পাদদেশে তৈরী হয় বসতঘর। পাহাড় কাটা ও বসতঘর তৈরীর নেপথ্যে থাকে রাজনৈতিক ছত্রছায়া। তাই প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করেন। পরিবার পরিজন নিয়ে মাথা গুজাবার বিকল্প জায়গা নেই। তাই ভ‚মিহীন মানুষ পাহাড়ের পাদদেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সরকারী খাস জায়গাতে ঠাঁই নেন। দীর্ঘ প্রায় ৩ যুগেরও বেশী সময় ধরে চলছে এমন বে-আইনী কাজ। কিন্তু কিছুতেই তা থামানো যাচ্ছেনা।

উপজেলার ঘুমধুম পাহাড়ী এলাকা ঘুরে দেখা গেল এমন দৃশ্য। এই উপজেলার স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যানুযায়ী পাহাড়ের চ‚ড়া আর পাদদেশে এরকম ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারীদের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার।

স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, উপজেলায় ইতিপুর্বে মাটি কাটতে গিয়ে অন্তত ১০-১২ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। আর ভারি বর্ষণে টিলার মাটি ধসে মা মেয়েসহ গত ৫ বছরে অন্তত ১০ জনের প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া পাহাড়-টিলা ধসে শিশুসহ অসংখ্য ব্যাক্তি আহতও হয়েছেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন নিয়ে কাজ করা বান্দরবনের বিকাশ চক্রবর্তী বলেন, ওই চক্রের কাছে পরিবেশ আইন শুধুই ‘নীতিবাক্য’। অব্যাহত টিলা কাটার ফলে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এ অঞ্চলের নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। আর এরই সাথে বদলে যাচ্ছে ভূ-মানচিত্রও।

সম্প্রতি সরেজমিনে উপজেলার বাইশারী ইউনিয়ন সদর ,ঘুমধুম ইউনিয়ন সদর,দোছড়ি ইউনিয়ন সদর,সোনাইছড়ি ইউনিয়ন
এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, স্থানীয় থানা পুলিশের নাকের ডগায় বিনা বাধায় চলছে পাহাড় কাটা।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (সংশোধিত) অনুযায়ী পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ হওয়া স্বত্বেও এখানে পরিবেশ আইনের কোন প্রয়োগই চোখে পড়ছেনা। ফলে অব্যাহতভাবে পাহাড় কাটা যেন থামছেনা বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে পুলিশের ছত্রছায়ায়। অব্যাহতভাবে পাহাড় কাটা বিষয়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে প্রশাসনকে অবহিত করা হলে অজ্ঞাত কারনে কোন ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।

স্থানীয় এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পাহাড় কাটা পরিবেশ আইনে সর্ম্প‚ণভাবে নিষিদ্ধ হওয়া স্বত্বেও ঘুমধুমের বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কাটার খবর শুনেছি। তিনি পাহাড় কাটা বন্ধে প্রশাসনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী বলেও মনে করেন।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এসএম সরোয়ার কামাল বলেন, পাহাড় কাটার বিষয়টি আমি জানিনা। তবে এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

(ওএস/এসপি/মার্চ ০২, ২০১৮)