ছাদেকুল ইসলাম রুবেল, গাইবান্ধা : গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কাপাসিয়া ইউনিয়নের পোড়ারচর গ্রামের বোচাগাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা প্রায়দিনই দেরি করে আসেন। প্রধান শিক্ষক মোকলেছুর রহমান হাজিরা খাতায় তাদেরকে অনুপস্থিত দেখাননি। উল্টো নিজেও প্রস্থানের জায়গায় সময় আগেই লিখে রেখেছেন।

এ ছাড়া ছুটিতে যাওয়ার আগেই তিনি তার স্বাক্ষরের জায়গায় লিখে রেখেছেন নৈমিত্তিক ছুটি। এসব শিক্ষকরা দেরিতে বিদ্যালয়ে আসায় শিক্ষার্থীদের পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে।

বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৭২ সালে স্থাপিত এই বিদ্যালয়টি সরকারিকরণ করা হয় ২০১৩ সালে। শিক্ষক রয়েছেন ৫ জন ও ছাত্র-ছাত্রী ৯৪ জন। ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ইউপি সদস্য রেজাউল ইসলাম বিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী নুর হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করার জন্য নিয়েছেন। বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উপস্থিত হতে দেরি হলে তিনি ক্লাস নেন।

গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার কামারজানী ইউনিয়নের কামারজানী বাজার। এখান থেকে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় তিস্তা নদীর উত্তর-পূর্বে ১৫ মিনিট যাওয়ার পর নামতে হয় পোড়ারচর গ্রামের ঘাটে। এই ঘাট থেকে বালুচরে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই যাওয়া যায় এই বিদ্যালয়ে।

সোমবার দুপুর পৌনে ১২টায় বিদ্যালয়টিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান শিক্ষক মো. মোকলেছুর রহমান অফিস কক্ষে ও নুর হোসেন তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাচ্ছেন। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কক্ষে কোনো শিক্ষক নেই। শিক্ষার্থীরা গল্পগুজব করছে।

প্রধান শিক্ষক মো. মোকলেছুর রহমান জানালেন, বিদ্যালয়ে এখনও সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. সোলায়মান ইসলাম, সহকারী শিক্ষক রেহেনা পারভীন, তুহিন জান্নাত ও আব্দুল হাফিজ বিদ্যালয়ে আসেননি। দুপুর দেড়টার দিকে এই চার শিক্ষকের মধ্যে সোলায়মান ইসলাম, রেহেনা পারভীন ও আব্দুল হাফিজ বিদ্যালয়ে উপস্থিত হন।

দেরিতে বিদ্যালয়ে আসার কারণ জানতে চাইলে এই শিক্ষকরা জানান, কামারজানী ঘাটে নৌকা না পাওয়ায় আজ (সোমবার) বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে দেরি হয়েছে।

মোকলেছুর রহমান আরও জানান, তিনি নিজে ও সোলায়মান ইসলাম থাকেন কামারজানী বাজারের পার্শ্ববর্তী এলাকায়। সহকারী শিক্ষক রেহেনা পারভীনের বাড়ি সুন্দরগঞ্জের শ্রীপুর ইউনিয়ন, তুহিন জান্নাত ও আব্দুল হাফিজের বাড়ি শান্তিরাম ইউনিয়নে হলেও তারা সকলে থাকেন গাইবান্ধা জেলা শহরে। ফলে তাদের বিদ্যালয়ে পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়। কেননা গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে কামারজানী বাজারের দূরত্ব ১৭ কিলোমিটার। সেখান থেকে নদীপথে ও হেঁটে বিদ্যালয়ে পৌঁছাতে সময় লাগে আরও প্রায় ২০ মিনিট।

শিক্ষক হাজিরা খাতায় স্বাক্ষরের সময় প্রধান শিক্ষক মোকলেছুর রহমান প্রস্থানের জায়গায় সাড়ে ৪টা লিখে রেখেছেন। অন্যান্য শিক্ষকরা দুপুর দেড়টা পর্যন্ত বিদ্যালয়ে উপস্থিত না হলেও তাদেরকে অনুপস্থিত দেখাননি তিনি। এ ছাড়া তিনি নিজে ছুটিতে যাওয়ার আগেই ৩ ও ৪ তারিখে তার স্বাক্ষরের জায়গায় নৈমিত্তিক ছুটি লিখে রেখেছেন।

স্থানীয়রা জানান, এই শিক্ষকরা প্রায়দিনই বেলা ১১টার পর বিদ্যালয়ে আসেন। বারবার বিদ্যালয়ের সভাপতি ও প্রধান শিক্ষককে জানিয়েও কোনো কাজ হয়নি। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক না থাকলে শিক্ষার্থীরা বাহিরে খেলাধুলা করে ও বসে গল্প করে। এ জন্য সব শিক্ষকরা টাকা দিয়ে নুর হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে বিদ্যালয়ে পাঠদান করার জন্য রেখেছেন। যখন শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে পৌঁছাতে দেরি করেন তখন নুর হোসেন শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক অভিভাবক বলেন, এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রায় প্রতিদিনই ১১টার পর বিদ্যালয়ে আসেন। আর বিদ্যালয় বন্ধ করে চলেও যান তাড়াতাড়ি।

নুর হোসেন বলেন, বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির নির্দেশে আমি বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস নিই। এর বিনিময়ে মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা করে পাই। কিন্তু এই টাকা কোথায় থেকে আসে সেটা আমি জানি না।

প্রধান শিক্ষক মোকলেছুর রহমান বলেন, এই শিক্ষকরা প্রায়দিনই দেরি করে বিদ্যালয়ে আসেন। সেসময় শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে বসে গল্প করে। বারবার সাবধান করেও তাদেরকে মাসের বেশিরভাগ দিনই নির্ধারিত সময়ে বিদ্যালয়ে পাওয়া যায় না।

দেরিতে শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়ার সত্যতা স্বীকার করে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ইউপি সদস্য রেজাউল ইসলাম বলেন, কামারজানী ঘাটে নৌকা না পাওয়ার কারণে শিক্ষকদের বিদ্যালয়ে আসতে দেরি হয়। তবে এটা প্রতিদিন হয় না, মাঝেমধ্যে হয়। এজন্য নুর হোসেন নামের একজনকে নেয়া হয়েছে। শিক্ষকরা দেরিতে আসলে যাতে তিনি শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতে পারেন।

তিনি দাবি করেন, অন্যান্য বিদ্যালয়ের চেয়ে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অত্যন্ত দায়িত্বশীল।

(এসআইআর/এসপি/এপ্রিল ০৩, ২০১৮)