প্রবীর সিকদার : ফরিদপুরের প্রথম আলোর প্রতিনিধি পান্না বালা আর আমি আশির দশকে প্রায় একই সময়ে লেখালেখি শুরু করি। ওর বয়স আমার চেয়ে একটু কম হওয়ায় আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা দাদা-ভাইয়ের। সম্পর্কও খুব চমৎকার। কখনো সম্পর্কের অবনতি দূরে থাকুক, মান-অভিমানও হয়নি। খুবই মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন গুণী ছেলে পান্না।

গত বৃহস্পতিবার ওর সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়েছে। আমি ওর কাছে জাতীয় শোকদিবস ১৫ আগস্টের জন্য ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো’ এই শিরোনামে বঙ্গবন্ধুর ওপর একটি লেখা চেয়েছি। পান্না তার সহজাত হাঁসিতেই আশ্বস্ত করেছে, ১০ আগস্টের মধ্যেই লেখাটি আমি পেয়ে যাবো। এখন আমার কষ্ট হচ্ছে, ওর লেখাটি আমি আর পাচ্ছি না!

শুক্রবার সকালে আমি ফার্মগেটে আমার ‘কুটির শিল্প’ দৈনিক বাংলা ৭১ ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ কার্যালয়ে কাজ করছিলাম। এরই মধ্যে ফরিদপুর থেকে আমার অগ্রজ শ্রদ্ধাভাজন সাংবাদিক মুনশী হারুন ভাই টেলিফোন করলেন। কুশলাদি বিনিময়ের পর তিনি হতবাক করা খবরটি জানালেন, পান্নার স্ত্রী জয়ন্তী ওই দিন ভোরের দিকে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। মোটামুটি খোঁজ খবর নিয়ে আমি ফোন করলাম ফরিদপুরে কর্মরত আমার স্নেহভাজন এক সাংবাদিককে। ওই সাংবাদিক একই কথা জানিয়ে বললো, ওরা পান্নাদের বাসাতেই আছে। পুলিশ এসেছে। লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করছে। ময়না তদন্ত হবে। পরে আবার ওই সাংবাদিককে ফোন করে জানলাম, সুরতহাল রিপোর্টে জয়ন্তীর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। গলায় শুধু রশির দাগ রয়েছে। ময়না তদন্ত শেষে জয়ন্তীর লাশ পান্নার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বিকেলে শহরের অম্বিকাপুর শ্মশানে সৎকার করা হয়েছে।

বুকের গভীরে খুব বড় ক্ষত তৈরী হয়েছে। কেনো এমন হলো পান্নার? কয়েক জনের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করে যা জানলাম, তা হলো, ওদের দু‘জনের মধ্যেই বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু জয়ন্তী একটু বেশি জেদি প্রকৃতির মেয়ে ছিল। ওদের ৯ বছরের একটি মেয়ে আছে। নাম কস্তুরি। ওর পড়াশুনা নিয়ে সম্প্রতি একটু অভিমান দানা বেধেঁছিল জয়ন্তীর মনে। আর সেই সূত্রেই হতে পারে এই আত্মহত্যার ঘটনা।

রাত ১১ টার দিকে ফরিদপুরের আরেকজন সাংবাদিক আমাকে টেলিফোন করলো। জানালো, কোতয়ালী থানা পুলিশ পান্নাকে গ্রেফতার করেছে। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, পুলিশের কাছে পান্নাকে গ্রেফতারের কি ভিত্তি আছে? সে জানালো, পান্নার স্ত্রী জয়ন্তীর ভাই মনোজ কান্তি সরকার থানায় হত্যা মামলা দায়ের করায় পুলিশ পান্নাকে বাসা থেকে নিয়ে গেছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, পুলিশের কাছে এই অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো কেন? সাংবাদিকটি জানালো ,পুলিশ প্রথমে অভিযোগটি আমলে নেয়নি। পরে সরকারের সবচেয়ে ক্ষমতাধর একটি দপ্তরের এক কর্মকর্তা টেলিফোন করায় পুলিশ অভিযোগ গ্রহণ এবং পান্নাকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়েছে। আমি অস্থির হয়ে গেলাম, পান্না খুনী! এটা কি সম্ভব! আমি পান্নাকে চিনি। যে ছেলেটি পায়ের নিচে পড়ে পিঁপড়া মরলে আঁতকে ওঠে। সে খুন করবে নিজের স্ত্রীকে!

আমার এলোমেলো ভাবনা গুলো এক সংকীর্ণ জায়গায় গিয়ে আটকে গেল। এই দেশে তাহলে আইনের আশ্রয় পেতে হলে প্রভাবশালী কেউ হতে হয়! যারা প্রভাবশালী নয়, তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্তা-ব্যক্তিদের নজরেই থাকেন না! কী আজব চেহারা পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের এই বাংলাদেশ!

আমি খুবই সাদামাটা একজন সংবাদ কর্মী। খুবই প্রভাবশালী কয়েক রাজাকারের একাত্তরের কুকীর্তি উন্মোচন করায় আমার ওপর নৃশংস হামলা হয়েছিল। বোমায় উড়ে গেছে পা। গুলি-চাপাতির কোপে কর্মক্ষমতা হারিয়েছে একটি হাত। শরীরে বোমার অনেক স্প্লিন্টার। কোনো বিচার পাইনি। কারন আমি প্রভাবশালী নই, প্রভাবশালীদেরও কেউ নই।

সেই আমাকে গত ১৭মে , ২০১৪ তারিখে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। হুমকি দেয়া হয় আগুনে পুড়িয়ে গ্রিল করা হবে। আমি ঘটনাটি প্রায় সাথে সাথেই শেরে বাংলা নগর থানাকে লিখিত ভাবে জানাই। জিডি নং ১১৯২ তাং ১৭.০৫.২০১৪। সেই ঘটনারও কিছুই হয়নি। কিন্তু আমি জানি, এমন ঘটনা যখন কোনো প্রভাবশালীদের বেলায় ঘটে, এক ঘন্টার মধ্যে আ্যাকশন শুরু হয়ে যায়। আমি যদি দেশের ‘কেউকেটা’ ধরনের কেউ হতাম, আইন আমার আগেই দৌড়াতো!

প্রভাবশালী কারো ফোন! পান্নাকে তো কারাগারে ঢুকতেই হবে! কিসের ময়না তদন্ত রিপোর্টের অপেক্ষা! এই না হলে বাংলাদেশ!

এখন খুব কষ্ট হচ্ছে কস্তুরির জন্য। বেচারি মাকে হারালো! বাবাকেও ঢুকিয়ে দেওয়া হলো কারাগারে! এখন কে আছে আর ওর?