চাটমোহর (পাবনা) প্রতিনিধি : নিয়মিত ট্রেন যাচ্ছে-আসছে রাজশাহী-ঢাকা রেলপথে। এই রেলপথের পাবনা অংশে চাটমোহর ও বড়ালব্রিজ রেলস্টেশনে টিকেট কালোবাজারীদের দৌরাত্ম যেন বাড়ছেই। নিয়মিত দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা।

স্টেশনের টিকেট কাউন্টারে টিকেট না মিললেও বাইরে অহরহ মিলছে টিকেট, তবে তা বেশি দামে। বিক্রেতা কালোবাজারী চক্র। কিন্তু দেখার যেন কেউ নেই। যাদের দেখার কথা তারা আছেন আরাম আয়েশে চোখ বুঁজে। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। টিকেট কালোবাজারীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে অসহায় সাধারণ যাত্রীরা। এ চিত্র আজকের নয়, দীর্ঘদিনের। তারপরও সমাধান মিলছে না। রেল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতা এ জন্য দায়ী বলে মনে করেন ভুক্তভোগীরা।
সম্প্রতি চাটমোহর স্টেশন সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়, টিকিট কাউন্টারও খোলা। টিকিট বিক্রেতাও আছেন বসে। সরকারি ভবন, সরকারি ফ্যান। গায়ে হাওয়াও লাগাচ্ছেন বেশ। কারণ কাউন্টারে টিকিট বিক্রির তোড়জোড় নেই। টিকিট বিক্রেতার মুখে ওই এক রা- ‘টিকিট নাই, টিকিট নাই’। বিক্রেতার কাছে ট্রেনের কোনো টিকিট না থাকলেও ‘সোনার হরিণ’ আছে কালোবাজারিদের হাতে। শুধু ঈদ নয়, সারা বছরই ট্রেনের টিকিট কালেবাজারি নিয়ে চাটমোহর রেলস্টেশনে গড়ে উঠেছে সর্বদলীয় এক সিন্ডিকেট। স্টেশনের কাউন্টারে টিকিট না থাকলেও প্লাটফর্ম থেকে শুরু করে পাশের চায়ের স্টল, সিগারেটের দোকান-সবখানেই প্রকাশ্যে টিকিট বিক্রি করছে কালোবাজারিরা। বাধাহীন এ ব্যবসা দিনের পর দিন চলতে থাকায় চাটমোহর স্টেশনে এটাই এখন স্বাভাবিক নিয়ম। আর সব জেনেও নিরব প্রশাসন ও রেল কর্তৃপক্ষ।
চাটমোহর স্টেশন থেকে প্রতিদিন সকাল থেকে আন্ত:নগর সিল্ক সিটি, দ্রুতযান, চিত্রা, পদ্মা, ধূমকেতু ও সুন্দরবন এক্সপেস নামের ছয়টি আন্ত:নগর, সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ও একটি লোকাল ট্রেনসহ আটটি ট্রেন নিয়মিত চলাচল করে। এসব ট্রেনে চলাচলকারী যাত্রীরা টিকিট কিনতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েন সব সময়।
রেল কর্মকর্তারা জানান, প্রতিদিন স্টেশন থেকে এসব ট্রেনের যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত টিকিটের সংখ্যা ১৫০টি। ঈদ বা বিশেষ সময়ে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৮০টিতে।
শফিকুল ইসলাম ও মাসুদ রানা নামের দুই রেলযাত্রী ঢাকা যাচ্ছিলেন। আলাপকালে তারা জানান, স্টেশনের কাউন্টারে কোনো যাত্রী টিকিট সংগ্রহ করতে গেলেই বলা হয়, ‘টিকিট নাই’। অথচ অল্প সময়ের মধ্যেই দুই থেকে তিনজনের কালোবাজারি দল নির্ধারিত দামের চেয়ে ৫০ থেকে ১০০ বা এরও বেশি দামে টিকিট নিয়ে হাজির হয়।
পুরো প্লাটফর্মে অপেক্ষমাণ বেশির ভাগ যাত্রী জানান, তাঁরা একইভাবে টিকিট সংগ্রহ করেছেন। কারণ কাউন্টারে গেলে বলা হয় টিকেট আছে কিন্তু সিট নাই। বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে সিট নাম্বার সম্বলিত টিকেট কিনতে হয়। আর চাটমোহর থেকে যে টিকেট কাউন্টার থেকে কিনতে হতো ২৫০ টাকায়। সেই টিকেট কালোবাজারীদের কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকায়। কখনও সুযোগ বুঝে এর চেয়েও আরও বেশি দাম নেয় চক্রটি।
প্রকাশ্যে দিনের পর দিন এভাবে টিকিট বিক্রি হলেও যেন দেখার কেউ নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চাটমোহর স্টেশনের টিকিট কালোবাজারিরা একটি সর্বদলীয় সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। তাদের কাজে প্রতিবাদ করলেই প্রতিবাদকারীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। এ কারণে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চায় না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্টেশনসংলগ্ন এলাকাবাসী জানায়, পুরো টিকিট কালোবাজারি চলছে লিটন, কালাম, জাহিদ, আইনুল, হানিফ, আলাল, শাহাদত, শামীম, জলিলসহ আরো কয়েকজনের নিয়ন্ত্রণে। তাদের মধ্যে শাহাদত, শামীম ও জলিল নিজেদের বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের এবং বাকিরা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের বলে নিজেদের দাবি করে। এই চক্রের দুই সদস্য আলাল আর হানিফ সম্প্রতি টিকিট কালোবাজারি করার সময় সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। এর বাইরে টিকিট কালোবাজারি ও অন্যান্য অসাধু কাজের দায়ে সম্প্রতি চাটমোহর স্টেশনের বুকিং ক্লার্ক জাহিদ হোসেনকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয় বলে স্টেশন সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়। এছাড়া ট্রেনের টিকেট কালোবাজারী চক্রের সাথে চাটমোহর থানা পুলিশেরও দহরম মহরম সম্পর্ক রয়েছে বলে একাধিক সুত্র জানায়। সুত্রের ভাষ্যমতে কালোবাজারীদের কাছ থেকে পুলিশ অনৈতিক সুবিধা নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযানে নামে না।
এ বিষয়ে মূলগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন জানান, এসব কালোবাজারির পেছনে রয়েছে বেশ কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। এসব ব্যবসায়ী নেপথ্যে থেকে কালোবাজারিদের অর্থ জোগান দেয়। তিনি আরো জানান, স্টেশনে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে কালোবাজারিরা তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এর আগে কয়েকবার ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি প্রতিরোধে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। চেয়ারম্যান আরো জানান, কালোবাজারিরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- এ দুই দলের কর্মী-সমর্থক হওয়ায় ভয়ে কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে না। তবে স্টেশন মাস্টার থেকে শুরু করে কয়েকজন কর্মকর্তা কর্মচারী ঠিক থাকলে এমন অনিয়ম হতোনা। প্রশাসনের কঠোর নজরদারী দরকার বলেও মনে করেন তিনি।
টিকেট কালোবাজারী চক্রের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার কথা অস্বীকার করে চাটমোহর থানার ওসি সুব্রত কুমার সরকার বলেন, স্টেশন থেকে অতিরিক্ত টিকিট সরবরাহ করার কারণেই এ কালোবাজারির ঘটনা ঘটে। কালোবাজারির সঙ্গে স্টেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশের অভিযোগ করে ওসি বলেন, স্টেশনের কর্মকর্তারা নিয়ম মেনে চললেই কালোবাজারি বন্ধ হয়ে যাবে।
চাটমোহর রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার মহিউল ইসলাম টিকিট কালোবাজারির কথা পরোক্ষভাবে স্বীকার করে জানান, ‘ভাই, এ বিষয়ে কথা বলতে আমি খুব লজ্জা বোধ করি। এই স্টেশনে আর চাকরি করতে ইচ্ছা হয় না। আমার কাউন্টারে টিকিট থাকে না। অথচ বাইরের লোক টিকিট বিক্রি করে। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে?’ কিভাবে এই টিকিটগুলো বাইরে যায় জানতে চাইলে স্টেশন মাস্টার বলেন, কারো না কারো ছত্রচ্ছায়ায় এ কাজগুলো হয়ে থাকে। তিনি জানান, শুধু চাটমোহরের টিকিটই না, এ স্টেশন থেকে উল্লাপাড়া, বড়ালব্রিজ, এম মনসুর আলী স্টেশন, রাজশাহীসহ বিভিন্ন স্টেশনের টিকিট কালোবাজারিরা বিক্রি করছে।
স্টেশনের বুকিং ক্লার্ক শামীম হোসেন বলেন, ‘কেউ যদি একটার জায়গায় চার-পাঁচটা টিকিট কেনে, সে ক্ষেত্রে আমরা তো মানা করতে পারি না।’ এভাবেই অনেক টিকিট বের হয়ে যাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে বড়ালব্রিজ ও ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশনেও বিরাজ করছে প্রায় একই অবস্থা। কালোবাজারীদের দাপটে টিকেট পাওয়া দুষ্কর এ স্টেশনের যাত্রীদের। মাঝে মধ্যে ঘটে হাতাহাতি। সর্বশেষ গত ১ আগষ্ট ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশনে টিকেট কাটা নিয়ে কালোবাজারী দুই গ্রুপের সংঘর্ষে দুইজন নিহত হয়। রেল কর্তৃপক্ষে উদাসীনতায় টিকেট কালোবাজারীদের এমন দাপট বলে মনে করেন ভুক্তভোগীরা। খুব শীঘ্রই কালোবাজারী বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া না হলে এমন আরও প্রাণহানীর ঘটনা ঘটতে পারে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
(এসএইচএম/এএস/আগস্ট ০৬, ২০১৪)