রহিম আব্দুর রহিম


ষড়ঋতুর বাংলাদেশ। আমাদের ঋতু বৈচিত্রের পরিক্রমামালায় গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। এই ছয় ঋতুর বারোটি মাসের অপূর্ব বর্ষডালায় রয়েছে, বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়-শ্রাবণ, ভাদ্র-আশ্বিন, কার্তিক অগ্রহায়ণ, পৌষ-মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র। এই মাসগুলোর নামকরণ হয়েছিল, এক-একটি নক্ষত্রের নামে। পৃথিবীর সভ্যতায় মানুষ জাতি যখন, জীবন জীবিকার তাগিদে গণনা করার জন্য সংখ্যা, অঙ্ক, একক পরিমাপের প্রয়োজনীয় অনুভব করেন তখনই মানব সভ্যতায় আবির্ভূত হয় দিনপুঞ্জি, সন-তারিখ। আর সেই আমল থেকেই মানুষের জীবন বৈচিত্রের নানা কল্প কাহিনীর জেগে ওঠা ছবিই প্রকাশ পেয়েছে সাহিত্যমালায়। সাহিত্যের ছোয়ায় সময়ের পরিক্রমা বাংলা সনের মূল কাঠামো গঠিত হয় হিজরিসনকে ভিত্তি করে। সময়ের চলমান গতিধারায় একটি করে নতুন দিনের উদয় হয় এবং একটি দিন হারিয়ে যায়। পৃথিবী তার মেরুরেখার ওপর একবার ঘুরপাক খেয়ে দিন-রাতের সৃষ্টি হয়। এই দিন-রাতের ছয় ঋতুর বারো মাসের ঘুর্ণায়নে ‘নববর্ষের আবিষ্কার’। সম্রাট আকবরের আমলে অর্থাৎ ১৫১৭ অব্দ থেকে নববর্ষের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে সেই অনাদিকাল থেকে বাঙালির নানা আয়োজন। দোকানে দোকানে ‘হালখাতা’ গ্রাম, পাড়া-মহল্লায় জনমানুষের মিলনমেলা, কবি-সাহিত্যিকদের সাহিত্য রসের ব্যঞ্জনায় ভরে ওঠে প্রকৃতির আলো বাতাস। মনে-প্রাণে, ধ্যান-ধারণায় ভাবরসে জমে ওঠে পল্লীবালা। শুধু তাই নয়, নববর্ষের বোশেখে আমাদের যেমন আনন্দ এনে দেয়, তেমনি আবার প্রকৃতিক দূর্যোগের দুঃসংবাদ আমাদের আতঙ্কিত করে। তাইতো কবি নজরুলের কবিতায় ওঠে আসে,

‘ওরে তোরা সব জয়ধ্বনি কর, ওরে তোরা সব জয়ধ্বনি কর,
ওই নতুনের কেতন ওড়ে কাল বৈশাখের ঝড়, ওরে তোরা সব জয়ধ্বনি কর।’

এই বোশেখের প্রকৃতিও অপূর্ব ! দেখার মত, অন্ধকার বিকেল, ঝড়োবাতাস, দ্বৈত্য সমান গাছের নূইয়ে পড়া, মগডালের মর্মর শব্দ, শুকনো পাতা ঝরার মৃদু ঝংকার, ভাবসাহিত্যে কতইনা মজার! নববর্ষের শুরুর কয়েকদিন আগে থেকেই গ্রাম শহরের বাড়িঘরে শুরু হয়ে যায় অলেখিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার। মা-ঝিয়েদের নাড়–-মোয়া, ছানার মুড়কি তৈরির ঢেঁকিশালের কচকচানিতে মুখর হয়ে ওঠে সারাবাড়ি। দোকানিদের বছর শেষের হিসাব মিলানোর আয়োজনে সুঁতলী সুঁতায় কলার পাতা তৈরি গেট পেরিয়ে বাকী পরিশোধের আসরে হাজির হয় পাড়া-প্রতিবেশীরা।

রাতের আধাঁরে হ্যাজাক বাতির আলোতে ওই আঙ্গিনায় বসে জারি-সারি, পালাগান। খেঁটে খাওয়া মানুষের জীবন-জীবিকা, হাসি-কান্নায় পরিপূর্ণ এসমস্ত পালাগান রাতভর উপভোগ করেন গ্রামের বয়ঃবৃদ্ধ, আবাল-বণিতা, নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোররা। শহর অঞ্চলের শুরু হয় যাত্রাপালা, বটতলায়, হাটখোলায় বসে বৈশাখী মেলা। এই মেলায় সার্কাস, পুতুল নাচ, জাদুখেলা, লাঠিখেলা, সঙ্গ ও ঢং এর নাচ, ঘোড়দৌড়, ষাড়ের লড়াই। দোকানদাররা সাজানো পসরায় কেনাবেচায় শিশুরা পায়, মাটির পুতুল, কাঠেরঘোড়া, টিনেরজাহাজ, মুড়ি-মুড়কি, খই-বাতাসা, কদমা, খাগরাই, জিলাপী, রসগোল্লা এবং এক পয়সার তালপাতার বাঁশি। মাটির তৈরি হাতি-ঘোড়া। গাঁয়ের বধূদের জন্য বিক্রি হয়, স্নো-পাউডার, আলতা-সাবান, শীতলপাটি।

কিষাণ-কিষাণীদের জন্য মেলায় পাওয়া যায় পিড়া, লাঙ্গল- জোয়াল, দাঁ-বটি, কাস্তে-কোদাল, বাঁশের কুলা-ডালা, খলই, পাখির খাঁচা, ঝুড়ি, মাদুর, চাটাই। পাওয়া যায় কৃষি ফল-ফসল, ডাব-তরমুজ, বাঙ্গি, খিরা, বেল। নববর্ষের বোশেখ উপলক্ষ্যে ঘরে ঘরে খাবার দাবারের আয়োজন যেমন হয়, তেমনি একে অন্যের বাড়ি প্রাণের টানেই অলিখিত নিমন্ত্রণে যোগ দেয়। পাড়া-মহল্লায়, বাউলরা ঢোল-খোল, সেতারা-সারিন্দা বাজিয়ে জমিয়ে তোলে সুরের ভূবন। সবচেয়ে শিশু কিশোররা সারা বোশেখ জুড়েই চুটিয়ে অংশ নেয় ঘুড়ি খেলায়। নববর্ষ বা বোশেখ কোন জাতি বা গোষ্ঠীর একক অনুষ্ঠান নয়।

তবে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের লোকেরা তাদের নিজস্ব ধর্মীয় সংষ্কৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে নববর্ষ পালন করে থাকে। এদেশে ৪৫টি ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা রয়েছে যারা বাঙালি নয়, তারা তাদের মত করেই বর্ষবিদায় এবং বর্ষবরণ মহা ধুমধামের সাথে উৎযাপন করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসিরা ‘চৈত্র সংক্রান্তি’ এবং বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে ‘বৈসাবি’ মারমা আদিবাসিরা ‘সাংগ্রাই’ এবং চাকমা ও তঞ্চাঙ্গা আদিবাসিরা ‘বিঝু’ উৎসব পালন করে। শুধু যে আমাদের দেশেই বর্ষবরণ বা নববর্ষ পালন হয় তা কিন্তু নয়। গবেষকদের মতে প্রায় চার হাজার বছর আগে ব্যাবিলনে নববর্ষ তথা বর্ষবরণ উৎসবের সূচনা হয়েছিল। ওই সময় বছর শুরুর ঋতু ছিল বসন্তকাল। নৃ-তত্ত্ববিদদের মতে, যে কোন জাতি, গোষ্ঠী, সমাজ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সভ্যতা ও সংষ্কৃতির জন্য নববর্ষ এক গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। বাংলাদেশী বাঙালিদের মতই পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষরা তাদের সংষ্কৃতির সাথে মিল রেখে নববর্ষ পালন করে আসছে।

এর মধ্যে ভারতে কালীপূজা উপলক্ষ্যে ‘দীপাবলি’, মায়ানমারে একক দেবীর উপাসনা করে জুলাইমাসে নববর্ষ উদযাপন হয়, কোরিয়ায় চন্দ্রমাসে ‘সোল-নাল’ অর্থাৎ নববর্ষ, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন, আতশবাজির মধ্য দিয়ে নববর্ষ পালন করে। জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সুইজারল্যান্ড জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ, অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টা থেকে তাদের নববর্ষের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করে। ভিয়েতনাম একই আদলে নববর্ষ পালন করে থাকে। তাদের বিশ্বাস ঈশ্বর ঘরে ঘরে বাস করেন। নববর্ষের দিন ঈশ্বর স্বর্গে চলে যান এবং সেখান থেকে মর্ত্যরে লোকেরা কি করছেন? তা খতিয়ে দেখেন। এই ঈশ্বর স্বর্গে যায় কার্প মাছের পিঠে চড়ে। তাই নববর্ষের দিনে কার্প মাছ নদীতে ও পুকুরে আনুষ্ঠানিকভাবে ছেড়ে দিয়ে নববর্ষ উদযাপন করে থাকে। ইরানে ‘নওরোজ’ নামে নববর্ষ পালিত হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ্য ইরানে ২১ মার্চ আনন্দ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে নববর্ষ পালন করে থাকে।

এছাড়াও সুইজারল্যান্ড, রাশিয়া, চীন, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, ম্যাস্কিকো ও জাপানসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই তাদের আচার আচরনের সাথে সঙ্গতী রেখে নববর্ষ পালন করে আসছে। তবে বাংলাদেশের বাঙালিদের নববর্ষের বোশেখ আসে কু-সংষ্কার, অন্ধত্ব, হিংসা-বিদ্বেষ, অনাচারকে পায়ে মাড়িয়ে নতুনত্বের অবগাহনে সত্য, সুন্দর এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার বারতা নিয়ে, নববর্ষের বোশেখ আসে আমাদের চিরসবুজের নববর্ষের জয়গান গেয়ে। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ওঠে আসে

‘তোমার অবলোকনের আবরণখোলা হে মানব
আপন উদার রুপে প্রকাশ কর।’

লেখক : শিক্ষক, শিশু সংগঠক, নাট্যকার ও গবেষক।