প্রবীর সিকদার


হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের পরিচয় ব্যবহার করেই সায়েদুজ্জামান জাহির দৈনিক আমাদের হবিগঞ্জ পত্রিকার সম্পাদক সুশান্ত দাশগুপ্তের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করেছেন। ওই মামলাতেই গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন সাংবাদিক সুশান্ত। ওই মামলাতে আরও আসামি করা হয়েছে দৈনিক আমার হবিগঞ্জের নির্বাহী সম্পাদক নুরুজ্জামান মানিক, বার্তা সম্পাদক রায়হানউদ্দিন সুমন, চিফ রিপোর্টার তারেক হাবিবসহ অজ্ঞাত পরিচয়ের আরও কয়েকজনকে।

ওই মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে, হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি ও হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি এডভোকেট আবু জাহির, হবিগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোতাচ্ছিরুল ইসলাম, লাখাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুশফিউল আলম আজাদ, শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ তালুকদার, হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মিজানুর রহমান, শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভার মেয়র সালেক মিয়া, হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি ইসমাইল হোসেন ও হবিগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শেখ ফরহাদ হোসেন।

মামলায় একাধিক অভিযোগের কথা বলা হয়েছে। সেই অভিযোগের মূল সুর দৈনিক আমার হবিগঞ্জ পত্রিকার প্রিন্ট ও অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত অনিয়ম দুর্নীতি অসঙ্গতির নানা খবর, ফেসবুকে সেগুলো শেয়ার করা ও ফেসবুকের বিভিন্ন স্ট্যাটাস। মামলার এজাহার তথা মামলার বিবরণী ও সাক্ষীদের পরিচয় আমাকে ভিন্ন ইঙ্গিত দিয়েছে, শুধুই খবর ও ফেসবুক স্ট্যাটাস মামলার মূল টার্গেট হয়; টার্গেট অন্যকিছু। সেই অন্য কিছু বলবার আগে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আটক দৈনিক আমার হবিগঞ্জের সম্পাদক ও প্রকাশক সুশান্ত দাশগুপ্তকে নিয়ে দুই চার কথা বলে নেওয়া জরুরি বোধ করছি। মেধাবী সুশান্ত দাশগুপ্ত এসএসসি ও এইচএসসি পড়াশোনা করেছেন হবিগঞ্জেই। পরে ছাত্র ছিলেন সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের। বরাবর তিনি বঙ্গবন্ধুর অনুসারী; ছিলেন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে দুর্দান্ত সক্রিয়। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর যখন আওয়ামীলীগের কর্মী সমর্থকেরা অনেকটাই কোণঠাসা, তখন আজকের এই সুশান্ত 'জয় বাংলা' 'জয় বঙ্গবন্ধু' শ্লোগানে মুখর করে রাখতেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। আওয়ামীলীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এই বিষয়টি জানার পর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতা কর্মীর সাহসের তারিফও করেছেন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে লন্ডন চলে যান সুশান্ত দাশগুপ্ত। লন্ডনেও সুশান্ত আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সেখানে উচ্চ শিক্ষা শেষ করে তিনি ফিরে আসেন হবিগঞ্জেই। যদিও তার স্ত্রী সন্তানেরা ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবেই রয়ে যান লন্ডনেই। সুশান্তেরও রয়েছে ইংল্যান্ডে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি। সুশান্তের মাথায় শুধুই দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি ব্রিটিশ নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেননি। দুই একবার লন্ডনে বেড়াতে যাওয়া ছাড়া তিনি এখন বছর জুড়েই থাকেন হবিগঞ্জে।

হবিগঞ্জে আওয়ামীলীগের রাজনীতিকে আরও পজিটিভ, সক্রিয় ও আধুনিক করতে মাঠে নেমে পড়েন সুশান্ত দাশগুপ্ত। সেই রাজনীতিকে শুদ্ধ করতে তিনি তার নিজের ভাবনার জায়গা থেকে প্রকাশ করেন দৈনিক আমার হবিগঞ্জ নামের একটি পত্রিকা। প্রিন্ট ভার্সনের পাশাপাশি চালু করেন অনলাইন ভার্সনও। সৃষ্টি করেন যুগান্তকারী একটি সংগঠন 'আমার এমপি ডট কম'। জাতীয় সংসদের সদস্যদের সাথে এলাকার মানুষের মেলবন্ধন ও জবাবদিহিতার এক অনবদ্য সৃষ্টি ওই 'আমার এমপি ডট কম'। প্রথাগত প্রভু-দাসের রাজনীতির বাইরে সুশান্তের এই উদ্যোগ সাধারণ মানুষের মধ্যে দারুণ সাড়া ফেলে দেয়। আর এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় সুশান্তের জন্য। হবিগঞ্জের আওয়ামীলীগে দখল যাদের, তারা প্রমাদ গুণতে শুরু করেন। নেতাদের পকেটে পকেটে ঘুরে বেড়ান যেসব সাংবাদিক, তারাও ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন নতুন ধারার স্পষ্ট সাংবাদিকতার প্রতি, যে ধারার জন্ম দিয়েছে সুশান্ত দাশগুপ্তের সম্পাদনায় প্রকাশ পাওয়া দৈনিক আমার হবিগঞ্জ। এই সুশান্ত দাশগুপ্ত সম্পর্কে যাদের একটু ধারণা রয়েছে, তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা এই মামলার বিবরণ একবার পড়লেই তাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে যায়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সাংবাদিক নেতৃত্ব বেশ আটঘাট বেঁধেই নেমেছেন। মামলার মূল আসামি সুশান্ত দাশগুপ্ত হলেও আরও আসামি করা হয়েছে দৈনিক আমার হবিগঞ্জের শীর্ষ তিন সাংবাদিককে। সেই সাথে রয়েছে আরও অজ্ঞাত পরিচয়ের লোকজন। অর্থাৎ যারাই সুশান্ত দাশগুপ্তের পাশে দাঁড়াবেন, তারাও অজ্ঞাত পরিচয়ের ওই ফরমেটে আসামি হয়ে যেতে পারেন একই মামলা্ন! মামলায় যাদেরকে সাক্ষী করা হয়েছে, তারা সবাই এখন হবিগঞ্জে আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী। সাক্ষীর তালিকায় রয়েছেন হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি। মামলার বাদি প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক, আর সাক্ষী সভাপতি; আর সেই সূত্রে পুরো হবিগঞ্জ প্রেসক্লাব বিচলিত ও ক্ষুব্ধ রাজনৈতিক নেতাদের ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারোরই বুঝতে অসুবিধা হয় না, কতোটা আটঘাট বেঁধে সুশান্ত দাশগুপ্তকে শায়েস্তা করতে মাঠে নেমেছেন হবিগঞ্জের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সাংবাদিক নেতৃত্ব! ওদের টার্গেট সাংবাদিক হিসেবে সুশান্ত দাশগুপ্তকে শুধু সাজা কিংবা শায়েস্তা করা নয়; ওদের সন্মিলিত ও অভিন্ন টার্গেট সুশান্ত দাশগুপ্তকে হবিগঞ্জ থেকে বিতাড়িত করা। হবিগঞ্জে আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে ও সাংবাদিকতায় নতুন ধারা সৃষ্টিতে সুশান্ত দাশগুপ্তের চেষ্টা তারা কিছুতেই সফল হতে দিবেন না। আর সেটি করার জন্য যতো জলে নামতে হয়, তারা সেটি করবেন।

অপরাজনীতি ও অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় দৈনিক আমার হবিগঞ্জ পত্রিকার সম্পাদক প্রকাশক ও আমার এমপি ডট কমের প্রতিষ্ঠাতা সুশান্ত দাশগুপ্ত আজ কারাগারে। তার একনিষ্ঠ সহকর্মী সহযোগীরা মামলা মাথায় নিয়ে হয়তো লুকিয়ে রয়েছেন। তার মানে কী সুশান্ত দাশগুপ্তরা এখানেই থেমে যাবেন! অবশ্যই নয়। মামলা ও কারাগার চিরস্থায়ী কোনও বিষয় নয়। সততা ও আধুনিকতার ধারায় থাকা সুশান্ত দাশগুপ্তরা থেমে থাকার নয়! একদিন এমন এক মামলাও হাজির হতে পারে, আজ যারা মামলার বাদি ও সাক্ষী, তারাও সেই মামলায় চলে যেতে পারেন আসামির কাঠগড়ায়; সুশান্তরাই হয়তো সেদিন 'জয় বাংলা' 'জয় বঙ্গবন্ধু' শ্লোগানে মুখর হয়ে তাদের বিচার ও শাস্তি দাবি করবেন। এমন দিন আসবেই। হবিগঞ্জের সাধারণ মানুষ লুটেরা দুর্বৃত্তদের বয়কট করবেন, করবেনই। এটি ইতিহাসেরই শিক্ষা।