পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংবাদ সস্মেলন : দুই শিশুকে আশ্রয়হীন করে বাবা-মাকে জেলে পাঠানোর অভিযোগ
রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার তুলসীডাঙা গ্রামের মারুফ হোসেনের তিন বছরের মেয়ে মার্জিয়া । এখনো মায়ের দুধ পান না করে থাকতে পারে না। তার বড় বোন মারিয়া কলারোয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। মার্জিয়া বড় বোন মারিয়ার কালে উঠে রোববার দুপুরে পার্শ্ববর্তী ঝিকরা গ্রামে বাবার বন্ধু আতিকুর রহমান শাম্পুর বাড়িতে ঈদ উপলক্ষ্যে হাতে মেহেন্দী লাগাতে গিয়েছিল। সেখান থেকে বাড়ি ফিরে ফুফু হাঁসি খাতুনের কাছে জানতে পারে তার বাবা ও মাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। ফুফুর সঙ্গে থানায় যেয়ে একটি বারের জন্য মায়ের দুধ খেতে চেয়েছিল মার্জিয়া। পুলিশ তার আব্দার না রেখে বাবা ও মাকে কোথায় কোথায় পাঠিয়ে দিয়েছে। হাতে পায়ে ধরেও গত তিন দিয়ে মায়ের কাছে নিয়ে যেয়ে তাকে কেউ দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেনি। তাদের বাড়িতে তালা মারা। এখন তারা থাকবে কোথায়?
মঙ্গলবার সকালে সাতক্ষীরার কলারেরয়া উপজেলার গদখালি গ্রামে ফুফু জোহরার বাড়িতে গেলে সাংবাদিকদের কাছে আকুতি জানায় মারিয়া। এ সময় বড় বোনের কোলে উঠে অসহায়ের মত ফ্যাল ফ্যাল করে সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে ছিল মািির্জয়া।
মারিয়া আরো জানায়, করোনার কারণে তাদেও কেউ রাখতে রাজী হচ্ছেন না। তাই ছোট বোনকে কোলে নিয়ে একবার ফজলু চাচার বাড়ি, একবার শাম্পু চাচার বাড়ি ও একবার ফুফুর বাড়ি ঘুরে ঘুরে কাটছে তার। বাবা ও মাকে পুলিশ যেন ছেড়ে দেয় সেজন্য আকুল আবেদন মারিয়ার।
তুলনসীডাঙা গ্রামের অমেদ আলী সরদারের মেয়ে হাঁসি খাতুন জানান, তিন ভাই ও চার বোন তারা। এক ভাই কয়েক বছর আগে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছে। কামরুজ্জামান ও মারুফ দু’ভাই একই বাড়িতে বসবাস করে।
হাসি খাতুন বলেন, ১২ বছর আগে বাবা মারা যান। বাবা মৃত্যুর আগে মায়ের নামে বসতবাড়িসহ তিন শতক জমি লিখে দিয়ে যান। ১০ বছর আগে ওই জমিসহ চার শতক খাস জমি ভাই কামরুজ্জামান কিনে নিয়েছে বলে কয়েক বছর আগে দাবি করে আসছিল। মায়ের নামে তিন শতক জমি অথচ সাত শতক জমি কিভাবে ভাই কিনল তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন হাঁসি খাতুন ও তার বোনেরা। ওই দলিলমূলে ভাই মারুফকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করে আসছিল কামরুজ্জামান ও তার স্ত্রী আয়েশা খাতুনসহ আয়েশার বাবার বাড়ির লোকজন। এ নিয়ে বিরোধের জের ধরে এক বছর আগে কামরুজ্জামানের শ্যালক জালালাবাদ গ্রামের বাবলুর রহমান, তার বাবা ও মা মারুফকে দায়ের কোপ মেরে মাথা ফাটিয়ে দেয়। এ ঘটনায় বাবলু জেলে ছিল কিছুদিন। মামলাটি বর্তমানে চলমান রয়েছে।
হাঁসি খাতুন আরো বলেন, বৃহষ্পতিবার সকালে মারুফের ব্যবহৃত একটি ঘর দখল করে নেয় কামরুজ্জামান। খুলনা থেকে ট্রাক নিয়ে ফিরে বিষয়টি জানতে পেরে ওই তালার উপর আরো একটি তালা মেরে দেয় মারুফ। বিষয়টি নিয়ে থানায় একটি অভিযোগও দেয় সে। কামরুজ্জামানও থানায় পাল্টা অভিযোগ দিলে শুক্রবার উপপরিদর্শক ইসরাফিল এসে নির্দেশ দিলে তালা দুটি ভেঙে ফেলে কামরুজ্জামান।
পরে জিনিসপত্র বের করে নিয়ে নতুন একটি তালা লাগিয়ে চাবি তার (হাঁসি)কাছে রাখতে বলেন উপপরিদর্শক ইসরাফিল। বিষয়টি ঈদের পর উভয়পক্ষকে নিয়ে থানয় বসাবসি করে মিটিয়ে দেওয়ার কথা বলেন তিনি। শনিবার তারাবি নামাজের আগে এ নিয়ে কামরুজ্জামান ও মারুফের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে উপপরিদর্শক ইসরাফিলসহ কয়েকজন পুলিশ এসে মারুফকে বাঁশ দিয়ে ও কিল, ঘুষি, লাথি মেরে জখম করে। ভাইকে রক্ষায় এগিয়ে গেলে তাকেও লাঞ্ছিত করে পুলিশ।
এ সময় পুলিশের উপস্থিতিতে মারুফের ঘরে ভাঙচুর, লুটপাট চালায় কামরুজ্জামান, তার স্ত্রীসহ তাদের সঙ্গীয় লোকজন। সাবিনা ভাঙচুরে বাধা দিয়ে তাকেও পিটিয়ে জখম করা হয়। পুলিশ চলে যাওয়ার পর মারুফ ও সাবিনাকে উদ্ধার করে কলারোয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।
হাঁসি খাতুন আরো জানান, হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালিন রোববার দুপুর ১২টায় কলারোয়া রিপোর্টার্স ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে মারুফ ও তার স্ত্রী বাড়িতে যায় কাপড় নিয়ে আসার জন্য। সংবাদ সস্মেলনের খবর পেয়ে উপপরিদর্শক ইসরাফিল ও এক মহিলা পুলিশসহ সাতজন এসে মারুফ ও তার স্ত্রীকে ধরে থানায় নিয়ে যায়। মার্জিয়াকে নিয়ে থানায় নিয়ে গেলে মায়ের দুধ খাওয়া জোটেনি। অসহায় দু’ শিশু কোথায় থাকবে এমন কথা বললে থানার বড় বাবু আদালতে যেয়ে বিচারকের মাধ্যমে সাবিনার কাছে তার বাচ্চাকে দেওয়ার পরামর্শ দেন। বিকেল চারটার দিকে তাদেরকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। ফলে করোনা পরিস্থিতিতে বাচ্চা দুটো প্রায় অভিভাবকহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
পুলিশের উপস্থিতিতে মারুফের ঘরে ভাঙচুর ও লুটপাটের কথা জানান, পার্শ্ববর্তী এক হারবাল ডাক্তারের মেয়ে তানিয়া ও অনিসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকজন। তারা উপপরিদর্শক ইসরাফিলের বিরুদ্ধে মারুফকে বাঁশের লাঠি দিয়ে এলোপাতাড়ি মারপিটের অভিযোগ করেন।
তবে কামরুজ্জামানের স্ত্রী আয়েশা খাতুন বলেন, তার স্বামীর নামে শ্বাশুড়ি সব জমি লিখে দিলেও রক্তের সম্পর্কের কারণে দেবর মরুফকে চান বছর আগে তাদের নিমিত বাড়িতে আশ্রয় দেওয়া হয়। মারুফের স্ত্রী সাবিনার সামাজিক সম্মান নেই দাবি কওে তিনি বলেন, ওই ঘওে বিভিন্ন ধরণের মানুষজন যাতায়াত করতো। এ নিয়ে বিরোধ তাদের। ঘুর্ণিঝড় আমপানে রান্না ঘর ভেঙে যাওয়ায় জিনিসপত্র একটি ঘরে রাখা নিয়ে মারুফের সঙ্গে বিরোধ বাঁধে। এ নিয়ে শুক্রবার তাকে ও তার স্বামীকে মারপিট করা হয়। বিষয়টি নিয়ে তারাও থানায় অভিযোগ করেন। রোববার পুলিশের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করার দু’ ঘণ্টা পর মারুফ ও তার স্ত্রীকে ধরে নিয়ে জেলে পাঠিয়েছে পুলিশ। মারুফের ঘর মারুফ ও তার স্ত্রী নিজেরাই ভাঙচুর করেছে বলে দাবি করেন তিনি।
তবে স্থানীয়রা জানান, কামরুজ্জামান থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির লোক ও মারুফ সাধারণ সম্পাদকের লোক বলে পরিচিত। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্্র করে পুলিশ যে শান্তিপূর্ণ মীমাংসার উদ্যোগ নিয়েছিল তা ব্যহত হয়েছে। মারুফকে মারপিটের অভিযোগ সঠিক হলেও সংবাদ সস্মেলনে পুলিশের বিরুদ্ধে ভাঙচুর, সোনার গহনা ও টাকা লুটপাটের অভিযোগ আনা হয়েছে সেটা ঠিক নয়।
কলারোয়া থানার উপপরিদর্শক ইসরাফিল হোসেন মঙ্গলবারি দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, তিনি রাগের বশবর্তী হয়ে মারুফকে দু’চারটি চড় মেরেছিলেন ঠিকই। কিন্তু বাড়ি ভঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগ ঠিক নয়। ২৪ মে ঘরের দেড় লাখ টাকার আসবাবপত্র ভাঙচুর ও ৩৫ হাজার টাকা লুটপারেট ঘটনায় কামরুজ্জামানের দায়েরকৃত মামলায় মারুফ ও তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে তাদের দুধের শিশু ছিল এটা তার জানা ছিল না।
কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনির উল গিয়াস বলেন, কামরুজ্জামানের অভিযোগের সত্যতা পেয়ে মামলা নিয়ে মারুফ ও তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। উপপরিদর্শক ইসরাফিলের বিরুদ্ধে ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগ সত্য নয় দাবি করে তিনি বলেন, বহুড়া গ্রামের অসহায় সোনাভান বিবি’র অসুস্থ স্বামীকে রেজিষ্ট্রি অফিসে নিয়ে বিনা টাকায় দু’ বিঘা জমি লিখে নিয়েছে একটি মহল। ওই ঘটনার তদন্তকারি কর্মকর্তা উপপরিদর্শক ইসরাফিল। অসহায় সোনাভান বিবির জমি তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা। এতেই ক্ষুব্ধ ওই মহলটি ইসরাফিলকে বদলী করানোর জন্য চরিত্রহননে নেমেছে। দুগ্ধপানকারি শিশু মারিয়াকে আদালতের মাধ্যমে তার মায়ের কাছে দিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি।
(আরকে/এসপি/মে ২৬, ২০২০)