প্রবীর সিকদার


আজ আমি দুটি ঘটনার অবতারণা করবো, দুটি ঘটনাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার। একটি সাম্প্রতিক নবীনগরের, আরেকটি পুরনো, নাসিরনগরের।

এক. নবীনগর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক কাজী মো.ওয়াজেদ উল্লাহ তার ফেসবুক আইডিতে বিকৃত তথ্য সম্বলিত একটি নিউজ লিংক ছড়িয়ে খুব চাতুর্যের সাথে ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াচ্ছিলেন। ওই লিংকে আমাদের বাংলাদেশ সচিবালয়কে 'হিন্দুয়ালয়' আখ্যা দিয়ে 'সচিবালয়ে মুসলমান নেই বললেই চলে, ৪০০ জন হিন্দু সচিব' বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এই বিষয়টি আমার নজরে আসায় আমি ফেসবুকে 'অবিলম্বে গ্রেফতার করা হোক নবীনগর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক কাজী মো.ওয়াজেদ উল্লাহকে' শীর্ষক একটি স্ট্যাটাস দেই। নবীনগরের সাংবাদিক গৌরাঙ্গ দেবনাথ অপুও একই বিষয়ে আর একটি স্ট্যাটাস দেন। মুহূর্তে তোলপাড় শুরু হয় নবীনগরের উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনে। ওই শিক্ষক কে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় নবীনগর থানায়। প্রশাসন ও পুলিশের সিরিয়াসনেস দেখে ঘাবড়ে যান শিক্ষক কাজী মো.ওয়াজেদ উল্লাহ। তিনি তার কৃতকর্মের জন্য থানা পুলিশের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আর এমন করবেন না, তার পোস্ট ডিলেট করবেন এবং ওই পোস্টের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ফেসবুকে নতুন স্ট্যাটাস দিবেন, এই মর্মে একটি মুচলেকা দিয়ে নবীনগর থানা পুলিশের হাত থেকে রেহাই পান শিক্ষক কাজী মো.ওয়াজেদ উল্লাহ।

দুই. নাসিরনগরের জেলে সম্প্রদায়ের তরুণ শ্রী রসরাজ দাস! লেখাপড়া না জানা রসরাজ পৈতৃক পেশা নদীতে মাছধরা, আর বাজারে তা বিক্রির মধ্যেই থাকেন। তিনি স্মার্ট ফোন ও ফেসবুক ব্যবহারও জানেন না! একটি দুর্বৃত্ত চক্র তার নাম ও ছবি ব্যবহার করে ফেসবুকে আইডি খোলে ও সেখানে ধর্মের অবমাননাকর ছবি ও লেখা পোস্ট করে। এটা নিয়ে সারা নাসিরনগর তথা ব্রাহ্মণবাড়িয়া তোলপাড় হয়ে যায়। রসরাজের ফাঁসি দাবি করে মিছিল হয়, রসরাজের বাড়িসহ সংখ্যালঘুদের শতাধিক বাড়ি ঘর মন্দিরে ভয়ঙ্কর হামলা হয়। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যান রসরাজ। ভয়ে লুকিয়ে থাকেন। খোঁজাখুঁজি করে নাসিরনগর থানা পুলিশ রসরাজকে গ্রেফতার করেন। তখন তার উপর চালানো হয় বর্বর নির্যাতন। রসরাজ দাসকে আসামী করে ৫৭ ধারায় দায়ের করা হয় মামলা। ওই মামলাতেই ঢুকতে হয়েছিল তাকে কারাগারে; সে কী ভয়ঙ্কর ভোগান্তি রসরাজের ও তার পরিবারের! পাড়াপড়শিরা ভোগ করেছেন নারকীয় তাণ্ডব! সেই ভোগান্তি যেন আজও কাটেনি! যদিও পরে পিবিআইয়ের তদন্তে সত্য প্রকাশ পায়, রসরাজ দাস অপরাধ করেননি; সেটি করেছে একটি সাম্প্রদায়িক দুষ্ট চক্র।

স্কুল শিক্ষক কাজী মো.ওয়াজেদ উল্লাহ ও রসরাজ দাসের অপরাধ ও তার বিচারিক ধরণ একই, ৫৭ ধারা কিংবা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ও বিচার। যদিও রসরাজ দাস কোনও অপরাধ না করেই ফেঁসেছেন! এক যাত্রায় দুই ফলের ঘটনায় বিস্মিত না হয়ে কী উপায় আছে কারো! ফেসবুকে রাষ্ট্র ও সরকার বিরোধী পোস্ট দিলেন নবীনগরের সরকারি স্কুল শিক্ষক কাজী মো.ওয়াজেদ উল্লাহ! নবীনগর থানা পুলিশের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেই পার পেয়ে গেলেন তিনি! আর নাসিরনগরের রসরাজ দাস অপরাধ না করেও ধর্ম অবমাননার অপরাধে ৫৭ ধারার মামলার আসামী হলেন, তাকে ঢুকতে হলো কারাগারে! রাষ্ট্র বিরোধী অপরাধ বিবেচনায় নবীনগর থানা পুলিশের কি দায়িত্ব ছিল না, ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করা এবং তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো? নবীনগর থানা পুলিশ কেন সেটা না করে ভয়ঙ্কর অপকর্ম ও অপরাধে জড়িত স্কুল শিক্ষককে জামাই আদরে ছেড়ে দিলেন? আমি নিশ্চিত করেই জানি, পুলিশের কাছে এই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর নেই! বিনা অপরাধে রসরাজের কারানির্যাতন ভোগ ও রাষ্ট্র বিরোধী অপরাধ করেও ওয়াজেদ উল্লাহর জামাই আদরে অব্যাহতি নিয়ে কেউ যদি বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলেন, একজনের নামের আগে 'মো.' আর অপর জনের নামের আগে 'শ্রী' থাকার কারণেই এক যাত্রায় দুই ফলের বিধান জারি রাখলেন পুলিশ; সেটা কী খুব বেশি ভুল হবে?

আমাদের দেশে বিনা অপরাধে কারাগারে ঢুকে যাওয়া, আবার অপরাধ করেও জামাই আদরে আইনের জাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মতো বহু ঘটনা ঘটে। ওয়াজেদ উল্লাহ ও রসরাজ দাসের ঘটনা দুটি তারই নজির। আর এই কারণেই আইন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে আস্থার সংকট তৈরি হয়। আইনের প্রয়োগ হতে হবে সবার জন্য সমান। একই অপরাধে ব্যক্তি বিশেষে শাস্তির ধরণ আলাদা হওয়া শুধু অবাঞ্ছনীয় নয়, অপরাধেরও! আমি মনে করি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উচিত, অপরাধী যেই হোক, তাকে অবশ্যই আইনে সোপর্দ করা। প্রয়োজনে আদালতে অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে অপরাধী আদালত থেকে বেকসুর খালাস পেয়ে যাক! সেক্ষেত্রে অপরাধী সম্পর্কে আদালতের নথিতে সুনির্দিষ্ট তথ্য সন্নিবেশিত থাকবে; অপরাধী সেটা সারা জীবন মনে রাখবে! ফের অপরাধ করবার সময় একবার হলেও ভেবে দেখবেন, তিনি আর অপরাধ করবেন কিনা! এভাবেই আমাদেরকে বিচার হীনতার অপসংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেতে পারি। সকল ক্ষেত্রে সুশাসন ও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা না গেলে কখনোই কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।