ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া গণতন্ত্র হচ্ছে আইয়ুব খানের ‘মৌলিক গণতন্ত্রের’ মত?
শিতাংশু গুহ
বাংলাদেশে সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা হলো ‘সোনার হরিণ’। রাম সোনার হরিণ ধরতে গেলে সেই ফাঁকে রাবন ছদ্মবেশে সীতা-কে হরণ করে। এই গল্পের উপসংহার হচ্ছে, সোনার হরিনের পেছনে না ছোটাই বুদ্ধিমানের কাজ। সোনার হরিণ অবাস্তব, যা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমও তাই। ওটা কেতাবে আছে, বাস্তবে নাই।
সেক্যুলারিজমের প্রসঙ্গ উত্থাপনের কারণ হচ্ছে, বছর দুই আগে দিল্লির এক নারীবাদী লেখিকা টুইট করেন যে, ‘ভারতে সেক্যুলারিজম হচ্ছে, ইসলামী মৌলবাদ, মাইনাস ‘টুপি’। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের মোল্লারা বলতে পারেন, ‘বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হচ্ছে হিন্দুত্ববাদ, মাইনাস ‘পূজা’। অনেকে বিষয়টা সেভাবেই দেখেন? কেউ কেউ বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা। বোদ্ধারা বলেন, সেক্যুলারিজম হচ্ছে, রাষ্ট্র থেকে ধর্মের পৃথিকীকরণ।
বাংলাদেশে সেক্যুলারিজম শব্দটি ডিকশনারিতে আছে, নেতারা মাঝে-সাঝে এনিয়ে গলাবাজি করেন, বাস্তবে এর লেশমাত্র চিহ্ন কোথাও নেই? তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি’র তেমন প্রচলন ছিলোনা। বঙ্গবন্ধু সংবিধানে এটি সংযোজন করে নিজের জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামাতে সাহায্য করেন। পার্লামেন্টে জাতির জনক এর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু কে শুনে কার কথা?
‘সেক্যুলারিজম’ কি বস্তু সরকার জনগণকে তা বোঝানোর প্রয়াস নেয়নি। ফলে জনগণ বুঝেছে বা স্বাধীনতা বিরোধীরা জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে হচ্ছে ধর্মহীনতা, অর্থাৎ ‘ইসলাম গেলো’? দেশটি সদ্য স্বাধীন, জাতি একটি লাল-সবুজ পতাকা পেয়েছে, কিন্তু মানুষগুলোর তো পাকিস্তানীই রয়ে গিয়েছিলো। সেক্যুলারিজম তাই সেদিনও গ্রহণযোগ্য ছিলোনা। আজও গ্রহণযোগ্য নয়।
একদা তুরস্কে সেক্যুলারিজম ছিলো। বাংলাদেশ ও তুরস্ক এখন দ্রুতলয়ে ইসলামী বলয়ে ঢুকছে। মুসলিম দেশগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষতা নাই। কারণ ইসলাম ও গণতন্ত্র সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশেও তাই থাকার কোন কারণ নাই। এসব ভালো জিনিষ পশ্চিমা উন্নত বিশ্ব বা নিদেনপক্ষে ভারতে মানায়, আমাদের দরকার নেই! আমাদের উন্নত চিকিৎসা বা শিক্ষাব্যবস্থার দরকার নেই? ওগুলোর জন্যে ‘বিদেশ’ আছে; অথবা ঘরের পাশে ভারত? উন্নত চিকিৎসার জন্যে আমরা সিঙ্গাপুর যাবো, নইলে মাদ্রাজ? শিক্ষার জন্যে ভারত, বা সুযোগ পেলে আমেরিকা?
আমরা দেখেও দেখিনা যে, বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলো সবই ধর্মনিরপেক্ষ। ধর্ম নির্বিশেষে ওরা সবাইকে মানুষ হিসাবে দেখে। ‘সেক্যুলারিজম’ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় একটি অন্যতম উপাদান। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সমাজব্যবস্থা পরিবর্তিত হচ্ছে। এই ‘বদলে যাওয়া’ হওয়া উচিত ‘ইতিবাচক’। বঙ্গবন্ধু’র স্বপ্ন ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা না হলে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নে মানুষ একদিন অধর্য্য হয়ে পড়বে। সেটা বুঝেই বঙ্গবন্ধু বাহাত্তরের সংবিধান দিয়েছিলেন।
মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ ধনী; কিন্তু সুযোগ পেলে ওরা সবাই আমেরিকা বা ইউরোপ পাড়ি জমাবে। বাংলাদেশের মানুষকে আমেরিকা বা সৌদি আরবের মধ্যে বেছে নেয়ার সুযোগ দিলে সবাই আমেরিকা যাবে। সৌদি আরব যাবে হজ্ব করতে, থাকবে আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া। কেন? এই কেন’র উত্তর হলো ‘ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা’। এর ওপর কোন ব্যবস্থা নাই? গণতন্ত্র চাই, আর ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া গণতন্ত্র আইয়ুব খানের ‘মৌলিক গণতন্ত্রের’ মত হয়ে যায়?
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্যেই ধর্মনিরপেক্ষতা দরকার। নূর হোসেন যেই গণতন্ত্রের জন্যে প্রাণ দিয়ে গেছেন, বাংলাদেশে সেই গণতন্ত্র এখনো ‘অধরা’ রয়ে গেছে। গণতন্ত্র ছাড়া মুক্তি নাই। মুক্তির জন্যে গণতন্ত্র চাই। বলা হয়, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর বাহাত্তরের সংবিধানের কফিনে শেষ পেরেকটি মারা হয়ে গেছে। সংবিধান তো মানুষের জন্যে, জনগণ চাইলে শেষ পেরেকটি খোলা কি খুব কঠিন? না খুললে কি হবে? দি বাংলাদেশ ক্রনিক্যাল ০২রা জুলাই ২০১৮-তে এক নিবন্ধে প্রশ্ন রেখেছে, বাংলাদেশ কি পাকিস্তান হবে না কাশ্মীর হবে?
লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।