আবীর আহাদ


মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন চলা উচিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে । এটা না হওয়ার কারণে প্রজাতন্ত্রের গোটা প্রশাসন চলে গেছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজাকার-আলবদরদের উত্তরাধিকারদের হাতে, যাদের এদেশটির প্রতি বিন্দুমাত্র আনুগত্য নেই । তাদের পূর্বসূরিদের মতো তারাও আদর্শিকভাবে এদেশের স্বাধীনতা ও বাঙালি জাতির প্রতি আস্থাশীল নয় । এদেশের মানুষের সুখ শান্তি কল্যাণ ও সমৃদ্ধি তাদের কাম্যও নয় । তারা চায় এদেশ, এ-জাতি ধ্বংস হয়ে যাক । তাই তো তারা বাংলাদেশের প্রশাসনের সর্বোচ্চ আসনে বসে বসে দুর্নীতি ও লুটপাটের হোলিখেলা চালিয়ে আসছে ।

এই স্বাধীনতাবিরোধী দুর্নীতিবাজরা এতোটি ধুরন্ধর যে, তারা অতি বিনয়ী আচরণ ও বিপুল অর্থ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একশ্রেণীর লোভী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বশে এনে প্রশাসনে অবস্থান করে পদোন্নতি ও ভালো ভালো লাভজনক স্থানে পোস্টিং, এমনকি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পর্যন্ত বাগিয়ে নেয় । তার জ্বলন্ত উদাহরণ সদ্যবিদায়ী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা: আবুল কালাম আজাদ । শুধু আমলা নয়, বিপুল অর্থ ছিটিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী রাজনীতিক বা তাদের উত্তরসূরি রাজনীতিকরাও যেকোনো ক্ষমতাসীন দলের এমপি-মন্ত্রীও হন । এরও জ্বলন্ত উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে ।

আজ যদি আপনি আমাদের সচিবালয়, বিভিন্ন অধিদপ্তর, অন্যান্য স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, ব্যাঙ্ক-বীমাসহ সরকারি আরো আরো প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকান, দেখতে পাবেন, বড়ো বড়ো সব পদে বসে আছে স্বাধীনতাবিরোধী পরিবার থেকে আগত----আপাদমস্তক দুর্নীতিবাজরা । আরো আশ্চর্য হয়ে দেখতে পাবেন, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বিএনপি-জামায়াত ঘরাণার এসব আমলারা (প্রশাসন, প্রকৌশল, চিকিত্সা প্রভৃতি ক্ষেত্রের কর্তাব্যক্তিরা) আওয়ামী লীগ সরকার ও রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের বিপুল পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা পেয়ে আসছে । আর এর অন্তরালে রয়েছে ঐসব ধুরন্ধরদের মধুর ব্যবহার ও বিপুল অর্থের ছড়াছড়ি ।

এ-প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে । আমি সাধারণত: কোনো মন্ত্রীর কাছে যাই না । অনেকদিন আগের কথা । তো একবার কী একটা জরুরী প্রয়োজনে একদিন রাতে আওয়ামী লীগ সরকারের এক ডাকসাইটে মন্ত্রীর বাসায় যাই । এ মন্ত্রী একদা ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা যিনি সুযোগ থাকলেও মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করননি । উপরন্তু তিনি ছিলেন আবার হানাদার বাহিনীর এক নামকরা দালালের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় । অর্থাত্ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শিবিরের এ-লোক রাতারাতি আওয়ামী লীগার বনে গিয়ে এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন ! মন্ত্রীর বাসায় যেয়ে দেখি, ভিজিটরদের অধিকাংশই সচিবালয়-কেন্দ্রিক বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত আমলা । তারা মন্ত্রী সাহেবের চারপাশে ঘনিষ্ঠভাবে বসে-দাঁড়িয়ে তাঁর সাথে মধুর ও বিনয়ী আলাপচারিতায় মশগুল । একদা সাংবাদিকতাসূত্রে সচিবালয়ের অধিকাংশ উচ্চপদস্থ আমলাদের সাথে পরিচয় ছিলো বলে সেদিন মন্ত্রী মহোদয়ের পাশে অবস্থানকারী অনেককেই চিনলাম । তারাই আমাকে মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিলেন । কাজটি সেরে বাইরে এসে হেঁটেছি আর ভেবেছি, আওয়ামী মন্ত্রী মহোদয়কে কী সুন্দরভাবে ঐসব ধান্দাবাজ আমলারা গিল খাচ্ছে-----!

একনাগাড়ে দীর্ঘকাল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার সুবাদে এভাবেই একশ্রেণীর আওয়ামী লীগ নেতা ও এমপি-মন্ত্রীদের হাত ধরে স্বাধীনতাবিরোধী পরিবার থেকে আগত আমলারা গোটা প্রশাসনকে তাদের কব্জায় নিয়ে নিয়েছে । মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনে যেখানে থাকার কথা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন, সেখানে আজ পুরোই অবস্থান করছে স্বাধীনতাবিরোধী দুর্নীতিবাজ ও লুটেরা আমলাতন্ত্র ! আজ বাংলাদেশের সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, সরকারি কেনাকাটাসহ ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য আর্থিক খাতে যে সব সাগরচুরির ঘটনা ঘটছে, তার সাথে ঐসব ধুরন্ধর দুর্নীতিবাজ আমলারা জড়িত । আর একটা বিষয় লক্ষণীয় ।

ইদানিং বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে বাংলাদেশের যে বিশাল ধনাঢ্য দশ লুটেরা ও মাফিয়ার কথা শোনা যায়, তাদের সবার অবস্থান মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শিবিরে-----মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কেউ নেই ! এমনকি বিভিন্ন স্তরের স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক বিভিন্ন দল, সংগঠন থেকে আগত অপরাধীচক্র আজ আওয়ামী লীগের দল ও সরকারের মধ্যে শক্ত অবস্থান করে নিয়েছে । এতেই বুঝা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতি, প্রশাসন আর্থিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক খাত কাদের নিয়ন্ত্রণে----সেখানে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ঐতিহ্যের নামধারী বর্তমান আওয়ামী লীগ সুদীর্ঘকাল ক্ষমতায় থেকে যেনো শুধু ঘাস কেটে চলেছে !

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক আর্থসামাজিক প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সর্বত্রে জেঁকেবসা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তিসমূহকে নিয়ন্ত্রণ ও ধ্বংস করতে না পারলে, যে গতিতে তারা ছলেকলেকৌশলে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো যাবে না । সুতরাং আর কোনো দ্বিধা নয়, আর কোনো দয়াদক্ষিণা নয়, আর কোনো বিবেচনা নয়, আর কোনো সংকীর্ণ আর্থিক লাভালাভ ও আত্মীয়তা নয়----নয় কোনো আপোসকামিতা----মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে, তার চেতনাকে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এক্ষুণি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে । কী সেই ব্যবস্থা ?

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ-নির্দেশনা ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে, অন্যান্য কিছু রাজনৈতিক দলের সহযোগিতায় এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বে । ফলে সংগত কারণে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে রক্ষা করা এবং মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে সরকার পরিচালিত হওয়া উচিত । বিশেষ করে----

(১) আওয়ামী লীগ ও এর অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, কেন্দ্রীয় ও উপদেষ্টা পরিষদের সর্বত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত সৎ, ত্যাগী ও মেধাবী লোকজনসহ মুক্তিযোদ্ধা/মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের নেতৃত্বের আসনে বসাতে হবে;

(২) ইউনিয়ন কাউন্সিল, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মূল দল ও সহযোগী সংগঠনের মধ্যকার সৎ, ত্যাগী ও মেধাবীদের মনোনয়ন
দিতে হবে;

(৩) নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং দল ও দলের বাইরে অবস্থানরত সৎ, ত্যাগী, অভিজ্ঞ ও মেধাবী লোকজনের সমন্বয়ে সরকারের মন্ত্রিসভা গঠন করতে হবে ;

(৪) প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে মন্ত্রী ও সচিবের মধ্যবর্তী একটি পদমর্যাদার তিন সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টামণ্ডলী থাকবে যারা মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম বিষয়ে পরামর্শ দেবেন;

(৫) সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও কেনাকাটা সংক্রান্ত বিষয়াদিতে সরকারি আমলাদের পাশাপাশি একটি তিন সদস্য বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও সংশ্লিষ্ট জ্ঞানসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে পরামর্শদাতা নিয়োগ করতে হবে;

(৬) বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফেরত আনতে হবে । অতীতে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আমলাতন্ত্র ও পিএসসির বিমাতৃসুলভ আচরণের জন্যে এ কোটা প্রতিফলিত না হওয়ার ফলে প্রশাসনে মুক্তিযোদ্ধা/তাদের উত্তরসূরিরা প্রবেশ করতে পারেনি, ফলে প্রশাসনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীরা জেঁকে বসেছে । মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাষ্ট্র কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি মর্যাদার প্রতীক ছিল । সেটি ফিরিয়ে এনে প্রজাতন্ত্রের সব সরকারি, আধা সরকারি ও সায়ত্তশাশিত সংস্থা, ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য সবস্তরে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৩০% কোটা কঠোরভাবে বলবৎ করতে হবে । পাবলিক সার্ভিস কমিশন তথা পিএসসিকে পরামর্শ দেয়ার লক্ষ্যে অভিজ্ঞ তিনজন মুক্তিযোদ্ধাকে পরামর্শদাতা নিয়োগ করতে হবে;

(৭) বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যাঙ্ক, বীমা, অন্যান্য আর্থিক সংস্থা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে পৃথক পৃথকভাবে তিন সদস্য বিশিষ্ট সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানসম্পন্ন মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে একটি পরামর্শদাতা নিয়োগ করতে হবে; এবং

(৮) জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (NSI), এসবি (SB), সিআইডি (CID) দুদক, বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি সংস্থায় এসব বিষয়ে অভিজ্ঞ তিনজন মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে একটি করে পরামর্শদাতা নিয়োগ করতে হবে ।

দেশের একজন সচেতন নাগরিক ও মুক্তিযোদ্ধা হিশেবে আমি দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় যেটা ভালো মনে করেছি, তারই আলোকে আমার এ প্রস্তাবনা জনসমক্ষে উত্থাপন করলাম । আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে পাথেয় জ্ঞান করেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশর সুখ শান্তি কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করেন, যারা বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনায় উদ্ভাসিত দেখতে চান, যারা দেশকে দুর্নীতি-সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাসমুক্ত দেখতে চান-----তারা নিশ্চয়ই আমার এ-প্রস্তাবটিকে আরো সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে তাদের বিজ্ঞ মতামত প্রদান করবেন ।


লেখক : গবেষক, চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।