শিতাংশু গুহ


আজ শুক্রবার, অনুপ-র মরদেহ নিয়ে সোমবার থেকে টানাটানি এবং গতকাল শেষকৃত্য হয়ে যাবার পর অনেকটা উদাস মনে সকালে লিভিং রুমে বসে ছিলাম, কোন কাজ করার ইচ্ছে ছিলোনা। অনুপ’র দিদি আলপনা গুহ’র একই অবস্থা। মাঝে মধ্যে এঁকে ওঁকে কল দিচ্ছিলাম। ডাঃ নুরুন নবী’র সাথে অনুপ-কে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ কথা বললাম। মনটা কিছুক্ষন শান্ত হলো। খানিক বাদে একটি কল এলো। অপরিচিত নাম্বার, অন্য ষ্টেট থেকে, ধরলাম।

অপর প্রান্ত থেকে বললেন, আমার নাম হিরণ্ময় বিশ্বাস। আপনার ফোন নাম্বারটি আমি ফিউনারেল হোম থেকে অনেক কষ্টে পেয়েছি, তাঁরা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে আমায় নাম্বারটি দিয়েছে। কণ্ঠস্বর শুনে মনে হলো ভদ্রলোক বয়স্ক। তিনি আবার বলেন, আমি একটি খুব খারাপ সংবাদ শুনে আপনার কাছে কল দিলাম। জিজ্ঞাস করলাম, আপনি ফিউনারেল হোমের নাম্বার পেলেন কোথেকে? বললেন, আমার কাছে এক ভদ্রলোক দু:সংবাদটি দিয়ে ফোন নাম্বারটি দিয়েছেন।

ও, আচ্ছা। ভদ্রলোক আমার নাম জিজ্ঞাসা করলেন। বললাম, ফিউনারেল হোম নাম্বার দিলো, নাম দেয়নি? না। আবার জিজ্ঞাসা করলাম, দু:সংবাদটা কি? তিনি বললেন, আমার পরিচিত এক ছোটভাই মারা গেছেন। সরি, যিনি মারা গেছেন, তাঁর নাম কি? বললেন, ‘শিতাংশু গুহ’। আমার তো আকাশ থেকে পড়ার মত অবস্থা। কনফার্ম হবার জন্যে আবার প্রশ্ন করলাম, ‘শিতাংশু গুহ’ মারা গেছেন। বললেন, হ্যাঁ। নিজেকে বেশ ভাগ্যবান মনে হচ্ছিলো, কারণ নিজের মৃত্যু সংবাদ তো সবার শুনে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়না?

হিরণ্ময় বিশ্বাসকে কি আমি চিনি? মনে পড়লো জগন্নাথ হলে আমাদের একজন শিক্ষকের নাম ছিলো ‘হিরণ্ময়’, আমরা বলতাম, ‘হিরণ্ময় স্যার’, টাইটেল ভুলে গেছি। ভাবলাম, স্যার এখনো বেঁচে আছেন? হিসাব করে দেখলাম, তাই যদি হয়, স্যারের বয়স একশ’র কাছাকাছি! ভয়েভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি কখনো ঢাকা ছিলেন? বললেন, হ্যাঁ। কখন? বললেন, ১৯৬৩ সালে আমি ঢাকা থেকে গ্রাজুয়েশন করি। ঢাকা ইউনিভার্সিটি? বললে, না, বুয়েট। যোগ করলেন, বুয়েট থেকে ‘এনভার্নমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ পাশ করি। বাঁচা গেলো, আমাদের হিরণ্ময় স্যার নন!

তিনি বলেছেন, আমরা ১৩জন তখন বুয়েট থেকে পাশ করে বের হই। তারপর জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএচডি করি। দীর্ঘদিন ইপিএ (ইনভারনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সী) চাকুরী করে এখন রিটায়ার লাইফ। থাকি গ্রীনস্প্রিং রিটায়ারমেন্ট হোমে। বয়স ৮০। তিনি তাঁর রুমের সরাসরি ফোন ও সেলফোন নাম্বার দিলেন। বোঝা গেলো যে, এটি অবস্থাসম্পন্ন মানুষের বৃদ্ধাশ্রম? জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার স্ত্রী? বললেন, তিনি আমেরিকান, থাকেন লাসভেগাসে, তাঁর সঙ্গী দু’টো কুকুর।

জিজ্ঞাসা করলাম, ঢাকা ছেড়েছেন কবে? বললেন, ১৯৬৪ সালে ঢাকা, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জে ভয়াবহ দাঙ্গার পর আমি ঢাকা ছেড়ে কলকাতা চলে যাই। জানতে চাইলাম, শিতাংশু গুহ-কে চেনেন কিভাবে? বললেন, আমার বন্ধু সাধনময় গুহ’র ছোটভাই শিতাংশু। একসময় শিতাংশু নিউইয়র্ক থাকতো। সাধনময় গুহ এবং ওঁর স্ত্রী সন্ধ্যা গুহ নিউজার্সির রার্টসগার্টস’এ থাকে। আমায় প্রশ্ন করলেন, আপনি কি ওদের চেনেন? ওদের টেলফোন নম্বর দিতে পারবেন? বললাম, না, চিনিনা, তবে টেলিফোন নাম্বার জোগাড় করে দিতে চেষ্টা করবো।

তিনি এরমধ্যে ক’বার আমার নাম জানতে চেয়েছেন, আমি এড়িয়ে গেছি। এবার বললাম, আমার নাম শিতাংশু গুহ, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আপনি কল দিয়েছেন, আমি মরিনি। তাঁর তেমন ভাবান্তর লক্ষ্য করিনি। হিরণ্ময় বিশ্বাস বললেন, জানেন, সন্ধ্যা গুহ’র ছোট মেয়েটি যখন হয়, আমি ওঁকে কোলে করে হাসপাতাল থেকে এনেছি। জিজ্ঞাসা করলাম, নাম কি? বললেন, মনে নেই, তবে তিনি ইপিএ-তে চাকুরী করেন এবং স্বামীর নাম, ঠিক বলতে পারলেন না, এটুকু বললেন, পদবি ‘বিশ্বাস’। আরো বললেন, রোহিনী বিশ্বাসের দুই মেয়ে, ওঁরা সম্ভবত: নিউইয়র্কে থাকে। রোহিনী বিশ্বাস কে তা আমার জানা হয়নি।

ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, কে মারা গেছে? বললাম, আমার স্ত্রী’র ইমিডিয়েট ছোটভাই অনুপ কুমার দাস। নৃত্যশিল্পী অনুপ কুমার দাশ’র মরদেহ ‘ভিউইং’ ছিলো বুধবার, দাহ বৃহস্পতিবার। আড্ডা’র (অনুপ দাশ ড্যান্স একাডেমী) শিক্ষার্থীরা এই মর্মে একটি ফ্লায়ার সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করে। তাতে ফিউনারেল হোমের নাম্বার, ঠিকানা ছিলো। কারো নাম ছিলো না। সামাজিক মাধ্যমে সেটি বেশ প্রচার পেয়েছে। ভদ্রলোক ঠিক কিভাবে ভাবলেন, শিতাংশু গুহ মারা গেছেন, তা জানিনা, হয়তো শিতাংশু গুহ’র শ্যালক মারা গেছেন, এই সংবাদ ভাসতে ভাসতে এক সময় ‘শ্যালক’ অংশটি বাদ পরে যায়, এবং তাঁর কাছে সংবাদ পৌঁছে, শিতাংশু মারা গেছে!

তিনি যেই শিতাংশু’র জন্যে শোকাতুর ছিলেন, আমি সেই শিতাংশু না হলেও, তাঁর আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ হয়েছি। তাঁরসাথে বেশ কিছুক্ষন কথা হয়েছে। বয়স্ক মানুষ কথা বলতে ভালোবাসেন। কেউ যদি সাধনময় গুহ/ সন্ধ্যা গুহ বা এঁদের পরিবারের খোঁজ জানেন, জানালে খুশি হবো। ভদ্রলোককে সরাসরি ফোন দিলে তিনি খুশি হবেন (হিরণ্ময় বিশ্বাস সেল: ৫৭১-৪৯৪-৬১৩৬/ রুম ৭০৩-২৭০-৫৯১৯)। আমাকেও জানাতে পারেন (৬৪৬-৬৯৬-৫৫৬৯)। সবশেষে, অনুপ কুমার দাশের শ্রাদ্ধ মঙ্গলবার, ৪ঠা আগষ্ট, বিকালে।

ইঞ্জিনিয়ার হলেও ভদ্রলোক রসিক আছেন। কথাবার্তার এক পর্যায়ে তিনি বললেন যে, কে যেন লিখেছেন ----মরিয়া প্রমান করিলো --- ইত্যাদি। বললাম, দাদা, রবীন্দ্রনাথের গল্প ‘কাদম্বিনী’, যেখানে কবিগুরু বলেছেন, ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমান করিলো সে মরে নাই’। ঠিক তেমনি ‘শিতাংশু গুহ, আপনার ফোন ধরিয়া প্রমান করিলো সে মরে নাই’! বললাম, আবারো আপনাকে ধন্যবাদ, আমি সত্বর আবার আপনার সাথে যোগাযোগ করবো।

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।