ফারুক আহমদ : পুণ্যভূমি সিলেট, এখানে শুয়ে আছেন আধ্যাত্মিক সাধক হযরত শাহজালাল ইয়ামেনী (রহঃ) ও তার প্রিয় ৩৬০ সহচর। প্রাচীন গৌড়ের রাজা গুহক তার প্রিয় মেয়ে শীলার স্মৃতির স্বার্থে একটি হাট স্থাপন করে নাম রাখেন শীলাহাট।

এই শীলাহাট থেকে পরে শ্রীহর হয়ে পরবর্তীতে সিলেট নামের উৎপত্তি। ১৭৮২ সালে ৩রা জানুয়ারি সিলেট জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। (সুত্রঃ সিলেট জেলা পরিষদ)। সিলেট আপনাকে মোহিত করে দিবে অপরূপ দৃশ্যে। সিলেটের শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ আপনাকে বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকবে তার পানে। সিলেট শহরের পুরাতন দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য- ঢেউ খেলানো চা-বাগান, হজরত শাহজালালের (রহ.) মাজার, হজরত শাহ পরানের মাজার, ওসমানী জাদুঘর, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, মুরারি চাঁদ কলেজ, কিণ ব্রিজ, আলী আমজাদের ঘড়ি, চাঁদনি ঘাটের সিঁড়ি, শাহী ঈদগাহ, গৌর গোবিন্দের টিলা ও সিলেটের প্রথম মুসলমান বোরহান উদ্দিনের মাজার। এছাড়া বিমানবন্দরের প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম দৃশ্য, ইকো পার্ক, নবনির্মিত সিলেট স্টেডিয়াম ও সিলেট পর্যটন কর্পোরেশন। সিলেট শহরের বাইরে দর্শনীয় জায়গা হলো- শ্রীমঙ্গল, শ্রীপুর, জাফলং, তামাবিল ও জৈন্তাপুর। এছাড়া শ্রী চৈতন্য দেবের মন্দির, জাফলংয়ের মত মোহনীয় স্থান।

ভ্রমণ কাহিনী: বিয়ের দাওয়াতে উপস্থিত হওয়ার জন্য আমার এই সিলেট যাত্রা। আমার অসম্ভব প্রিয় একজন মানুষের বাড়িও সিলেট শহরের তালতলায় অবস্থিত। যাওয়ার শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আগে কখনো যাওয়া হয়নি। সিলেট ভ্রমণের তিন দিনের কথা মনে পড়লেই এখনও মন আনচান হয়ে উঠে, মনে পড়ে অনেক দুঃসহ ও মায়াময় স্মৃতি। তবে তবুও ইচ্ছে হয় আবার সিলেট যাব। দেখব দু’নয়ন ভরে সিলেটের রূপ। যেখানে সেখানেই খুঁজে পাওয়া যায় প্রকৃতির নৈসর্গিক শোভা মণ্ডিত আকাশ, মায়াময় বন ঘেরা পাহাড় ও সারি সারি চা বাগানের অপরূপ সাঁজ।

অনেক সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগার পর ঢাকা থেকে পারাবতের শোভন টিকেট কেটে সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। সময়টি ছিল ২৭.০২.২০১৪ এর সকাল ৬.৪০মিনিট। সঙ্গী বলতে ছিল আমার সাথে থাকা দুইটি বই ও ব্যাগ যার মাঝে কিছু কাপড় চোপড় ও উপহার। একা একা বসে আছি কিন্তু নিয়তি কার জন্য কি লিখে রাখে কেউই বলতে পারেনা। পাশের সিটে বসা এক লোকের সাথে পরিচয় হলাম। জানতে পারলাম তারা তিন জন ভার্চুয়াল জগতের ফ্রেন্ড সিলেট ভ্রমণে যাচ্ছে। মজার বিষয় হল তারা কেউই পূর্ব পরিচিত নয়। যথারীতি ট্রেন কমলাপুর থেকে ছেড়ে গেল। সিলেট বিভাগে প্রবেশ করতেই চোখে পড়লো রাস্তার দুপাশে উঁচু নিচু টিলা, রাশি রাশি বাঁশ বাগান ও কাঁটাল বাগানের নয়নাভিরাম দৃশ্য। সবচেয়ে মন কাড়া রূপ দেখা যায় শ্রীমঙ্গলের চা বাগান ও সারি সারি লেবুর বাগান।

সিলেট ট্রেন স্টেশনটিও ছবির মত ছিমছাম ও মায়াবী পরিবেশে অপূর্ব রূপে সজ্জিত। রিকশায় উঠে সুরমা নদীর পাড়ে গিয়ে ব্রিজের সামনে নেমে পড়লাম। ব্রিটিশ আমলের তৈরি ব্রিজটি খানিকটা ধনুকের মত ও সরু। হেঁটে ব্রিজ পার হয়ে দেখি সুরমা পয়েন্ট হয়ে তালতলা। ক্লান্তি ভুলে গিয়ে মিশনে নেমে পড়লাম। আমার এই মিশনের নাম হল মিশন বাড়ি চার্চ। ইনডিকেটর জানা থাকায় বাড়ি খুঁজে পেতে কষ্ট হল না। কাঁধে ব্যাগ ও হাতের উপহারের চাপ মনের মধ্যে আঁচ কাটতে পারলো না। মিশন সফল হওয়ার পর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস আমাকে ছুঁয়ে গেল। আমার দু চোখ কবে শীতল হবে, কবে মনের মধ্যে তুফান উঠবে, এই প্রত্যাশা আবার আমাকে ছুঁয়ে গেল। কিন্তু বিঁধির লীলা অন্য রকম। হঠাৎ …………………… এমন একটা আচরণ আমার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। বাস্তবে নয় নিজের কল্পনায় এমন ভাবনাও হয়ে উঠেনি। তাই নিজের উপর অভিমান হল। প্রচণ্ড রাগ ও ক্ষোভ হাতে থাকা মোবাইলটার উপর দিয়ে গেল। খানিকটা রাগ কমানোর জন্য হযরত শাহজালাল (রহঃ) এর মাজার জিয়ারত করতে গেলাম।

“প্রথম আলো”র বন্ধু সভার পাতায় সৈয়দ শামসুল হক সম্পাদিত কবিতা নিয়ে প্রকাশিত “কলম বন্ধু” বইটিতে ছোট বোনের একখানা কবিতা “ক্ষণিকা” শিরোনামে ছাপা হল। বইটি তাঁকে পৌঁছানোর জন্য মনের ভিতর তাগিদ অনুভব করলাম। তাই দীর্ঘ এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে পৌঁছাইলাম।

পরদিন শুক্রবার মালিনী ছড়া চা-বাগান দেখতে গেলাম। বাগানে ঢুকে অবাক। যেদিকে তাকাই দেখি বনপথ। ওখানে গেলে যে কাহারো দু’নয়ন নিজেকে ভুলিয়ে দেবে। সঙ্গী ছিল ট্রেনের স্বল্প পরিচিত তিনজন। ওদিকে সিলেটের রূপে মুগ্ধ হয়ে দেখি এক পথিক গান ধরল : ‘সেথায় নাকি মন হারালে পায় না মনের দেখা/ পথের বাঁকে নতুন পথের শুরু/ না পাওয়াকে পাওয়ার আশায় হিয়া দুর দুর………। অতঃপর ইকো পার্ক হয়ে বিমান বন্দরের সৌন্দর্য আমাকে ছুঁয়ে গেল। তাড়া থাকায় রুমে চলে আসি।

মালিনী ছড়া চা বাগানে লেখক

বিকাল ৪টার কাছাকাছি মালঞ্চ কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছাইলাম। তারাজ ভাইয়ের সাথে আপুকে অর্থাৎ কনে দেখতে গেলাম। এবং আপুর সাথে নিজেকে ক্যামেরা বন্দী হলাম। অতঃপর ভাইয়া অর্থাৎ বর দেখতে গেলাম। তারাজ ভাই আমার পূর্ব পরিচিতও না। অল্প কয়েকদিন আগে ফেইসবুক ভাইয়ের সাথে পরিচয়। আর মাঝে মাঝে সেলফোনে কথা হত। ভাইয়ের সাথে জীবনের অনেক না বলা সুখ-দুঃখের কথা হল। যতদূর মনে হল তিনি আমাকে অনেক খানি উপলব্ধি করেছেন। তিনি আমাকে অনেক কিছু বুঝিয়েছেন। জীবনের ভুলগুলো দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

কনে ডাঃ শিউলির সাথে লেখক

পাঁচটার কাছাকাছি দেখা হল স্বর্ণা সাথে। মুচকি হাসি তার মুখে সব সময় লেগে থাকে। তাঁকে আমি গিন্নী নামে ডাকি, যদিও মাঝে মধ্যে বর না পাওয়ার অজুহাতে আমার ডাকে সাড়া দেয়না। তার ভীষণ ভয় যদি বর না পাই! আমার মত দেখতে চিকনা এক মেয়ে বললো “ভাইয়া আমাকে চিনেন?”। “আমি গরীব মানুষ জিপির জিরো ফেইসবুক ব্যবহার করি তাই আপনাকে চিনতে পারলাম না”। কথা হচ্ছিল তামান্নার ফিক্সির সাথে। সবাই ইনাকে তামান্না বিজি ডাকে। ইনাকে আমার সাথে একলা খেতে যেতে বললে ভয়ে কাঠ হয়ে যায়। এখনো তার চোখের পানি আমার মানস পটে ভাসছে। অন্যজন হলেন তাসরিন জাহান। তারাজ ভাই আর ইনি ভীষণ ঝগড়ায় ব্যস্ত। বিষয়টি আমি গোপন রাখলাম। প্রথম দিকে তার সাথে কথা বলতে খুবই ইতস্ত বোধ করলাম। সব কাটিয়ে তার সাথেও অনেক মজা হল। তবে ইনি সব সময় মোবাইল বন্ধ পান বলে জানা যায়। সব শেষে ফটো সেশন হল।

বাম দিক থেকে তারাজ, লেখক, রাহিমা, স্বর্ণা, তামান্না ও তাস্রিন এক ফ্রেমে

অতঃপর স্বর্ণা আর তারাজ ভাই…………………। ভীষণ মন খারাপ বিকালে আমার মুখে প্রছন্ন হাসি ফুটে উঠলো। দেখা হল শ্রদ্ধেয় মানুষের সাথে। মন তৃপ্তিতে ভরে গেল। বোনদের কাছে একটা মিথ্যা বলেছি। অসম্ভব সুন্দর সাঁজে তিন বোনকে দেখে মনে হল কোন অপরূপ সাঁজে স্বর্গীয় পরী। আমার জীবনে আবার ……………………… আরম্ভ হল নতুন দিগন্ত।

জানালার পাশে বসে দেখি, আকাশ হালকা মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। একটু পরে শুরু হলো গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। বসে বসে দেখছি সিলেটের কতই না রূপ। কেউ একজন বললো বর্ষায় এখানে বৃষ্টি পড়ে, গ্রীষ্মে প্রচণ্ড গরম, শরৎকাল-হেমন্তকাল, শীত, বসন্ত—এসবের দেখাও মেলে এই সিলেটে। এ জন্যই তো সিলেট অপরূপা। পরদিন গেলাম খাদিম নগরে সুন্দর শাহ এর মাজার জিয়ারত করতে। এবং শাহ পরান (রহঃ) এর মাজার জিয়ারত করে আসার সময় মুরারি চাঁদ কলেজের সামনে দিয়ে চাষনী পীরের মাজার জিয়ারত করতে। অতঃপর দেখতে গেলাম সিলেটের শাহী ঈদগাহ। মনে হলো, কত অপরূপ ঝলমলে এই শাহী ঈদগাহ। এটি স্থাপিত হয়েছিল মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে। ২০ মিনিট ঘুরে ঘুরে দেখলাম, শাহী ঈদগাহ। তবুও দেখার ইচ্ছে পূরণ হলো না। মনে হলো, সিলেটের আভিজাত্য বাড়িয়ে দিয়েছে এই শাহী ঈদগাহও।

পড়ন্ত বিকালে এলাম আলী আমজাদের ঘড়ি দেখতে। ব্রিটিশ আমলে বড় লাটকে চমকে দেয়ার জন্য ১৮৭৪ সালে লংলার পৃথ্বিমপাশা এস্টেটের জমিদার আলী আমজাদ এই বিচিত্র ও বিশাল ঘড়ি স্থাপন করেছিলেন…। সিলেট আমার স্বপ্নের শহর। বেঁচে থাকলে কারণে অকারণে বারবার ছুটে যাব সিলেটের অপরূপ রূপ সুধা পান করতে। এখনো আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে ………………।

লেখক : দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।