আবীর আহাদ


এ-কথা আজ নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে, অবাধ ক্ষমতা, অগাধ অর্থ, আত্মীয়তা ও নিজ কোটারী স্বার্থে দলের নি:স্বার্থ ত্যাগী, মেধাবী, সৎ, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে দু'পায়ে মাড়িয়ে রাজাকার, জামায়াতী, হেফাজতী, বিএনপি, শিবির, ছাত্রদলসহ সমাজবিরোধী দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের জামাই আদরে দল ও সরকারে ঠাঁই দেয়ার পরিণতি কী ভয়াবহ হতে পারে তার জ্বলন্ত প্রমাণ আজকের জরাজীর্ণ আওয়ামী লীগ ।

চারদিকে আজ দুর্নীতি ও লুটপাট, সভ্যতা ও ভব্যতার দলন, নৈতিকতা ও চারিত্রিক বিকৃতি, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক মূল্যবোধে চরম অবক্ষয়, অসুন্দর নষ্টামি ভণ্ডামি ও নষ্টাচার-ভ্রষ্টাচারের হোলিখেলা ইত্যাকার অশুভ কর্মযজ্ঞের ভেতর মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত বাংলাদেশ হাবুডুবু খাচ্ছে । সর্বত্র কেঁচো খুঁড়তে বড়ো বড়ো বিষধর সাপ বেরুচ্ছে । কালো টাকার প্রভাবে মাদক ও ব্যভিচারের করাল গ্রাসে বাঙালি সমাজ ডুবে যাচ্ছে । উন্নয়ন ও সরকারি কেনাকাটার অন্তরালে চলছে শতসহস্র কোটি টাকা লুটপাট । ব্যাংক ও পুঁজিবাজারে চলছে সাগর চুরি । হুণ্ডিসহ নানান উপায়ে দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে ।

প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের কোণঠাসা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী লোকদের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে নিয়োগ ও পদোন্নতি দিয়ে প্রশাসনকে রাজাকার ও দুর্নীতিবাজদের চেতনায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে । প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের বঞ্চিত করে প্রকারান্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়েছে । বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি না দিয়ে রীতিমতো মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মানিত করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না-----বিএনপি-জামায়াতের পথ অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে ভুয়া সংজ্ঞা সৃষ্টি করে হাজার হাজার অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকারদেরও মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য ত্যাগ ও বীরত্বকে অপমানিত করা হচ্ছে । স্বাধীনতার সূর্যসৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সিংহভাগ চরমতম মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিনাতিপাত করে চলেছেন । চিকিৎসার অভাবে ধুকে ধুকে মরছেন ।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তিকে পাশ কাটিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গিবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি হেফাজতে ইসলামকে মাথায় তোলা হচ্ছে, ফলে তারা শক্তি সঞ্চয় করে হেফাজতের তেঁতুল হুজুর নামক দামড়া আহমদ শফিকে দেশের রাষ্ট্রপতি করার দাবী তুলছে ! এই রাজাকার আহমদ শফি আল্লাহর এখতিয়ারটি নিজের হাতে তুলে নিয়ে যাকে-তাকে কাফের, বিধর্মী, মুরতাদ ও নাস্তিক ঘোষণা করে চলেছেন । এমনকি ধর্মীয় অঙ্গনে অত্যন্ত নিরীহ একটি সম্প্রদায় আহমদীয়া বা কাদিয়ানীদের কাফের ও অমুসলমান ঘোষণা করার জন্যে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে ধমক দিয়েছেন ! মূলত: স্বাধীনতাবিরোধী হেফাজত দেশে ধর্মীয় উন্মাদনায় দেশের মধ্যে একটি অরাজকতা সৃষ্টি করে হানাহানি ও রক্তপাত ঘটিয়ে একটি ধর্মান্ধতার বিপ্লবের মাধ্যমে আমাদের বহু কষ্টার্জিত বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে চায় । অপরদিকে প্রশাসনের অভ্যন্তরে লুক্কায়িত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আমলারা নিচের শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে হেফাজতের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক লেখনী সরিয়ে সাম্প্রদায়িক লেখনী সংযোজন করে চলেছে । রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিটি ইউনিয়ন ও উপজেলায় নানান কিংভূতকিমাকার মসজিদ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন ধরনের রাজাকারি ইসলামী ইন্সটিটিউট তৈরি করে জঙ্গি সৃষ্টির বীজ বপন করা হচ্ছে, যেসব মসজিদ মাদ্রাসা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ ও রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে সেগুলোকে কুফরি মতবাদ আখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষের মনোজগতে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে ।

কমিশন ও ঘুষ খেয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাঙ্ক, বীমা, চিকিত্সা, ঠিকাদারী, মিডিয়াসহ সর্বত্রই বিএনপি-জামায়াত তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী লোকদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে । একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারকে বিভিন্ন সিণ্ডিকেটের হাতে তুলে দিয়ে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে দুর্বিসহ যন্ত্রণার মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়েছে । এভাবে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে গুটিকতক দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের আশা-আকাঙ্খাকে পদদলিত করা হয়েছে । আর তার বিষফল স্বরূপ দেশে কেসিনো সম্রাট, ব্যাংকিং দরবেশ, ইয়বা কিং, করোনা রাজা-রাণী, মাদকসহ নানান অনৈতিক ব্যবসার মাধ্যমে বিশাল কালো টাকার মালিক বিকৃত রুচিসম্পন্ন অমানুষ ও গণিকা ললনাদের জঘন্যতম উত্থান ঘটেছে ।

এতকিছুর পরেও দেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষ বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিশেবে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর পরম আস্থা স্থাপন করে মুখ গুঁজে বসে আছে । তারা এও আশা করেন, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক দেউলিয়াত্ব থেকে মুক্তি দিতে জননেত্রী শেখ হাসিনার বিকল্প কোনো নেতৃত্ব নেই । বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও আদর্শের উত্তরাধিকারসহ সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ব্যক্তিগত সততা প্রজ্ঞা মেধা ও দূরদর্শিতা দিয়ে দেশকে সত্যিকারে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় পরিচালিত করতে পারেন । যদিও জননেত্রীর একটি কথা প্রায়ই আমাদের কানে ভাসে যে, তাঁকে ছাড়া আওয়ামী লীগের সবাইকে কেনা যায় । তাঁর একথার প্রতিবাদ করতে একজনও আওয়ামী নেতা-কর্মীকে দেখা গেলো না, যদিও তাঁর দলের বাইরে শুভানুধ্যায়ী মহল ও দেশের অন্যান্য সেক্টরে এখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রচুর সৎ মেধাবী ও ত্যাগী মানুষ আছেন যাদেরকে দুর্নীতি ও লুটতন্ত্র মোটেই স্পর্শ করতে পারেনি । আগেই বলেছি, বঙ্গবন্ধুর কন্যা এবং একজন সাহসী প্রজ্ঞাবান জাতীয় রাজনৈতিক নেতা হিশেবে শেখ হাসিনা যদি সেসব সৎ মেধাবী ও ত্যাগী মানুষদের খুঁজে তাঁর দল ও সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে অবস্থান দেন তাহলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ জাগ্রত হয়ে কাঙ্ক্ষিত পথে ধাবিত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই । অন্যথায় যে পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় দেশ চলছে, তাতে অচিরেই দেশটি চরম এক অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যাবে ।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।