প্রবীর সিকদার


পচাঁত্তরে আমি ঢাকার গেন্ডারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। যতোদূর মনে পড়ে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর দুই-তিন দিন স্কুলে যাওয়া হয়নি। একদিন সাহস করে স্কুলে হাজির হলাম। স্কুলে হাজিরা খুব কম। আমাদের ক্লাসে ৬/৭ জন হাজির হয়েছিলাম। ‘লাশ কাটা ঘর’-এর অনবদ্য স্রষ্টা, দেশের অন্যতম শক্তিশালী গল্পকার কায়েস আহমেদ আমাদের শিক্ষক ছিলেন। তিনি সেদিন আমাদের ক্লাসে এসেছিলেন বাংলা পড়াতে। কিন্তু না তিনি বাংলা পড়াননি। কায়েস স্যার বাম রাজনীতির অনুসারী ছিলেন। সেদিন তিনি ক্লাস শুরু করলেন বঙ্গবন্ধুর হৃদয়বিদারক মৃত্যু ও রাজনীতি দিয়ে। সেদিন তার অনেক কথার মর্মার্থ না বুঝলেও সেগুলো অন্তরে গাঁথা পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার তীব্র নিন্দা ও ঘৃনা জানিয়ে তিনি যা বলেছিলেন তা আজো কান ছুঁয়ে যায়। তিনি বলেছিলেন, 'সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দেশ প্রেমিককে ওরা খুন করলো! কি দোষ ছিল শিশু রাসেলের! মুক্তিযুদ্ধোত্তর একটি বিশৃঙ্খল বাংলাদেশকে তিনি যখন গুছিয়ে ফেলেছিলেন তখনই তাকে নৃশংসভাবে খুন করা হলো! এই জঘন্যতম খুনের ঘটনায় দেশবাসী সুদীর্ঘকাল দুর্ভোগ পোহাবে। পোয়াবারো হবে লুটেরাদের। এখন দেশের রাজনীতি চলে যাবে লুটেরাদের দখলে। দেশে দুই ধরনের মানুষের বাস। একটি শ্রেনী রাজনৈতিক, আরেকটি অরাজনৈতিক। লুটের রাজনীতি বিস্তৃত করতে দেশে এখন রাজনীতি বিমুখ একটি শ্রেনী তৈরী করা হবে, যারা রাজনীতির ওপর থেকে শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেলবে। এটি হবে এক সর্বনাশা খেলা। সত্যিকারের রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন হয়ে যাবে। এই দেশে এখন রাজনীতি হবে ভারত বিরোধীতার রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। ভারত বিরোধীতা ও সাম্প্রদায়িকতা সমার্থক হয়ে যাবে। ভারত বিদ্বেষ ছড়িয়ে ক্ষমতার মসনদ দখল করা হবে। বাস্তবে তারা হবে ভারতের সবচেয়ে বড় দালাল।' কথা গুলো বলতে বলতে কায়েস স্যার বেশ কয়েক বার চোখে রুমাল তুলেছেন। আমরা কিছু বুঝে কিংবা না বুঝে নির্বাক থেকেছি। আমার কাছে গল্পকার কায়েস আহমেদই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের প্রথম প্রতিবাদ। আজ সেই স্যারও নেই। নির্ভুল একজন ভবিষ্যত প্রবক্তা হিসেবে কায়েস স্যারকে প্রণতি জানাই।

ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে রক্তের দাগ শুকায়নি। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী সভার অনেকেই ঘাতক মোশতাকের মন্ত্রী সভায় ঠাঁই করে নিয়েছে। পিতা মুজিব! তুমি কাদেরকে জেলা, মহকুমা, থানা থেকে তুলে এনে জাতীয় রাজনীতির বাগানে ফুল বানিয়েছিলে? পরাজিতদের দলে বুঝি কেউ থাকতে চায় না!

বাসায় টেলিভিশন ছিল না। রেডিওতেই শুনেছি সব। ইত্তেফাকেও পড়েছি। কিন্তু কখনো ঘৃনা জাগাতে পারিনি। কী অকৃতজ্ঞ, কী কৃতঘ্ন সন্তান আমি!

পিতা মুজিব, আমায় ক্ষমা কর তুমি, ক্ষমা কর।