আবীর আহাদ


(গ) বঙ্গবন্ধু হত্যাযজ্ঞ

পনেরো আগস্ট । প্রথম প্রহর । রাত দেড়টা । মেজর ফারুক তার সহযোগীদের নিয়ে ইউনিট অফিসে প্রবেশ করে । ফারুক তার টেবিলের ওপর একখানা ঢাকার পর্যটন মানচিত্র মেলে ধরে । অন্যরা টেবিলের চারপাশে ঘিরে দাঁড়ায় । কোন কোন জায়গা ব্লক করতে হবে, কোথায় কোথায় অবস্থান নিতে হবে, কোথায় কোথায় অপারেশন করতে হবে সেসব স্থানে দাগ দেয় ফারুক ।

সেসব স্থানগুলো হলো-----

1. বঙ্গভবন
2. রক্ষিবাহিনী হেডকোয়ার্টার
3. বাংলাদেশ বেতার ভবন
4. টেলিভিশন কেন্দ্র
5. পিলখানা বিডিআর হেডকোয়ার্টার
6. মিরপুর ব্রিজ
7. তেজগাঁও এয়ারপোর্ট
8. মহাখালী রেলক্রসিং
9. ঢাকা সেনানিবাস দক্ষিণ গেট
10. যাত্রাবাড়ি মোড়
11. শেখ ফজলুল হক মণির বাসভবন
12. আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসভবন
13. রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের বাসভবন

কোথায় কোথায় কতোটি ট্যাঙ্ক কামান এবং কতোজন সৈন্য কার নেতৃত্বে অবস্থান নেবে সেসবের ছক আঁকলো ফারুক । 75 থেকে 150 জনের বড়ো দল তিনটিকে প্রধান তিন টার্গেট শেখ মুজিব, রব সেরনিয়াবাত ও শেখ মণির বাসায় অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হলো ।

মেজর নূর, মেজর মহিউদ্দিন ও মেজর বজলুল হুদাকে বঙ্গবন্ধু মুজিবকে, মেজর ডালিমের নেতৃত্বে রব সেরনিয়াবাতকে ও রিসালদার মোসলেহউদ্দিনের নেতৃত্বে শেখ মণির বাসভবন আক্রমণ ও উৎখাতের দায়িত্ব দেয়া হলো । সাধারণ সৈন্যদের উদ্দেশ্যে তাঁদের হত্যা করা হবে না বলা হলেও ঘাতক নেতা ফারুক সবাইকে হত্যা করার নির্দেশনা প্রদান করে ।

মেজর রশিদের দায়িত্ব ছিল মূলত: রাজনৈতিক । অপারেশন শুরু হওয়ার সাথে সাথে সে বিমান বাহিনীর স্কোয়ার্ডন লিডার লিয়াকতকে তার মিগগুলো নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলবে যাতে ঢাকার বাইরে থেকে সেনাবাহিনীর কোনো ইউনিট ঢাকায় আসার কোনো চেষ্টা না করে । দ্বিতীয়ত: সে খোন্দকার মোশতাককে রেডিও স্টেশনের নিয়ে আসবে ও মুজিব উৎখাতের ঘোষণা দেবে এবং তৃতীয়ত: সেনাসদরে গিয়ে সিনিয়র অফিসারদেরসহ বিমান ও নৌবাহিনী প্রধানকে রেডিও স্টেশনে এনে মোশতাককে রাষ্ট্রপতি মেনে নিয়ে নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের ব্যবস্থা করবে ।

আর অপারেশনের সবচেয়ে জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জাতীয় রক্ষিবাহিনীকে ট্যাকল করার দায়িত্ব নিলো স্বয়ং মেজর ফারুক ।

ভোর 4.30 মিনিটের মধ্যেই ফারুক-রশিদের ঘাতকবাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে গেল এবং অভিযানের জন্য তৈরি থাকলো ।

আর্টিলারির ক্রুরা নতুন বিমান বন্দরের কাছে তাদের কামান নিয়ে পজিশন নিলো । লান্সার গ্যারেজে লাইন ধরে দাঁড়ানো আছে আটাশটি ট্যাঙ্ক ও বারোটি ট্রাক, তিনটা জীপ এবং একটি 105 মি:মি: হাউটজারসহ ছ'শত সৈন্য । এর মধ্যে চারশো সৈন্য ছিল ফারুকের বেঙ্গল লান্সারের কালো পোষাকধারী ।

আশ্চর্য হলেও সত্য, এই যে বিশাল সামরিক আয়োজন যে-স্থানটিতে চলছে তার মাত্র কয়েক গজ দূরে ছিল ফিল্ড ইনটেলিজেন্সের কার্যালয়-----যেখানে প্রথা অনুযায়ী দিনরাত কাজ করার কথা । লান্সার ইউনিট ও ফিল্ড ইনটেলিজেন্সের মাঝখানে ছিল তারকাটার বেড়া । ফারুক এখানে পাহারাদার নিযুক্ত করে রেখেছিল যাতে যে কেউ এদিকে এসে খোঁজখবর নিতে এলেই তাকে গ্রেফতার করা হয় । আসলে বিষয়টিকে সবাই স্বাভাবিক প্রচলিত প্রশিক্ষণ মহড়া বলে ধরে নিয়েছিল । সাধারণ্যে এ মনো:স্তাত্ত্বিক বিষয়টিকে ঘাতকচক্র পূর্ণভাবে কাজে লাগিয়ে ছিল ।

ভোর পাঁচটা । ঘাতকবাহিনী রণসাজে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে যার যার গন্তব্যস্থলের দিকে যাত্রা শুরু করে । তখন পুবাকাশ ফর্সা হয়ে উঠছে ।

হাবিলদার জহুর বলেছে, আমরা যখনি চলতে শুরু করেছি তখনি অবাক হলাম, একটি ঘূর্ণিবায়ূ চারদিক থেকে আমাদের ওপর আছড়ে পড়লো । গাছগাছালি দুমড়ে মুছড়ে উঠলো । নানান পাখপাখালি কিচিরমিচির করে উঠলো । দূর থেকে কুকুর ও শেয়ালের বিলাপধ্বনি কানে বাজলো । আর তখনি ভেসে এলো পাশের মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি ।

ঘাতকবাহিনীর একশো' পঞ্চাশ সদস্যবিশিষ্ট দলটি যখন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে পৌছলো তখন ভোর পাঁচটা পঁচিশ মিনিট । চারদিক ফর্সা হয়ে উঠেছে । ঘাতকরা দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে বঙ্গবন্ধুভবন চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে । বাসভবনে পাহারারত লান্সার ইউনিট তাদের অফিসার ও জোয়ানদের দেখেই পথ করে দেয় । ঘাতকরা কতিপয় পুলিশকে আটক করে । বাকি কয়েকজন অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায় ।

বঙ্গবন্ধুর কতিপয় দেহরক্ষী বাসভবন ভর্তি নতুন লোক দেখেই পজিশন নেয় । ঘাতকবাহিনী এ সময় এলোপাথাড়ি গুলী ছুঁড়তে ছুঁড়তে গোটা বাসভবন ঘিরে ফেলে । তাদের ধারণা প্রতিরোধ আসছে । মূলত: ঘাতকবাহিনীর সদস্যরা যে গুলী ছুঁড়ছে এটা তাদের মনেই হয়নি । তাদের নিজেদের কারো বিক্ষিপ্ত গুলীতে প্রাণ হারায় ঘাতকবাহিনীর সদস্য হাবিলদার শামসুল আলম । তার মাথার খুলি উড়ে যায় । লান্সারের আরেক সদস্য নায়েক মোস্তাফা গুলীবিদ্ধ হয় । অবশ্য কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘাতকবাহিনী এবার পুরো বাসভবন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তল্লাশি চালাতে থাকে ।

ওদিকে প্রচন্ড গোলাগুলীর শব্দে শুনে বত্রিশ নং সড়কের মুখে স্থাপিত হাউটজারসহ ক্রুরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গোলা নিক্ষেপ করে । তারা ভেবে বসালো যে, প্রেসিডেন্টের বাসভবন থেকে বুঝি প্রবল প্রতিরোধ আসছে । ভীতসন্ত্রস্ত ক্রুদের নিক্ষিপ্ত পর পর দু'টি গোলা গিয়ে পড়লো ধানমন্ডি লেকের মধ্যে । এরপর তারা কামানের নল উঁচু করে এলোপাথাড়ি গোলা ছুঁড়তে থাকে । প্রতিটিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো । এর একটা গোলা গিয়ে পড়ে তিন মাইল দূরে মোহাম্মদপুরে । সেখানে জেনেভা ক্যাম্পে বিহারী পল্লীতে দুইজন নিহত ও কয়েকজন আহত হয় ।

এদিকে প্রচন্ড গুলীর শব্দে বঙ্গবন্ধু-পুত্র শেখ কামাল আকস্মকিতার উত্তেজনায় দোতলা থেকে দৌঁড়ে নিচে নেমে আসে । তার ধারণা হয়েছিল বুঝি সর্বহারা পার্টি আক্রমণ চালিয়েছে, লান্সাররা প্রতিরোধ করছে । হাবিলদার জহুর বলেছে, এ সময় শেখ কামাল নির্ভয়ে সৈন্যদের মাঝে এসে দাঁড়ায় । উত্তেজনায় হাঁফাতে হাঁফাতে কামাল বলে, আমি শেখ কামাল, কারা গোলাগুলীর করছে ! সহসা মেজর বজলুল হুদা পেছন থেকে শেখ কামালের মাথায় স্টেনগান থেকে গুলী করে । শেখ কামাল মুখ থুবড়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করে ।

প্রচন্ড গোলাগুলীর আওয়াজে বঙ্গবন্ধু জেগে উঠলেন । প্রথমেই তিনি ফোন করলেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল সফিউল্লাহর কাছে । অনেকক্ষণ পর ফোনে সেনাপ্রধানকে পেয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, এসব কী হচ্ছে, সফিউল্লাহ ? কারা এখানে গোলাগুলীর করছে ? ওরা বোধহয় কামালকে মেরে ফেলেছে !

জবাবে সফিউল্লাহর কম্পিতকন্ঠে বললেন, বঙ্গবন্ধু, আপনি কি কোনোভাবে বাইরে সরে পড়তে পারেন ! আমি কিছু একটা করার চেষ্টা করছি-----

বঙ্গবন্ধু সফিউল্লাহকে রেখে তাঁর সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার মাশহারুল হককে ফোনে সৈন্য পাঠাতে নির্দেশ দিলেন । বাইরে তখনো প্রচন্ড গোলাগুলীর শব্দ হচ্ছে । এবার তিনি রক্ষিবাহিনী হেডকোয়ার্টারে ফোন করলেন । রক্ষিবাহিনী প্রধান ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান ও উপপ্রধান কর্নেল সফিউদ্দিনের অনুপস্থিতিতে তিনি আর কাউকে ফোনে পেলেন না । শেষ ফোনটি করলেন মিলিটারি ইনটেলিজেন্স প্রধান কর্নেল জামিলকে ।

কর্নেল জামিল বঙ্গবন্ধুর ফোন পেয়ে স্লিপিং গাউন পরেই নিজের ব্যক্তিগত লাল ভক্সওয়াগান গাড়ি ড্রাইভ করে দ্রুত ছুটলেন বঙ্গবন্ধুভবনের দিকে । মিরপুর রোড থেকে বত্রিশ নং রোডে ঢুকতেই সৈন্যরা তার গতিরোধ করে । তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে গাড়ি টান দিতেই সৈন্যরা তাকে গুলী করে । গাড়িটি হুমড়ি খেয়ে পাশের দেয়ালে আছড়ে পড়ে । কর্নেল জামিল গাড়ির ভেতর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন ।

ওদিকে ঘাতকবাহিনী শেখ কামালকে গুলী করে মারার পর পরই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে । মেজর নূর, মহিউদ্দিন ও বজলুল হুদাসহ আততায়ীরা এক কক্ষ থেকে অপর কক্ষে ছুটোছুটি করতে থাকে ।

মেজর মহিউদ্দিন দোতলার সিঁড়ির প্রথম বাঁক ঘুরে ওপরে উঠতেই অপ্রত্যাশিতভাবে বঙ্গবন্ধুকে পেয়ে গেল । সে দেখলো, বঙ্গবন্ধু সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন । তাঁর পরনে চেক লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি । বাঁহাতের মুঠিতে চিরাচরিত সিগার পাইপ ।

নির্দেশ ছিল যে, প্রেসিডেন্টকে দেখামাত্র গুলী করে হত্যা করতে হবে । কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি হতেই মেজর মহিউদ্দিনের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে । বিহ্বলতায় বিচলিত মহিউদ্দিন গুলী না করেই কম্পিতকন্ঠে আমতা আমতা করে বললো, স্যার !

প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু মেজর মহিউদ্দিনকে কড়াভাষায় ধমক দিলেন, কী চাও তোমরা ?

স্যার স্যার, আপনি আসুন ! তেমনি বিপর্যস্ত কন্ঠে বলে মহিউদ্দিন, স্যা-----র !

বঙ্গবন্ধু আবার ধমকে বললেন, তোমরা কি আমাকে হত্যা করতে চাও ?

মেজর মহিউদ্দিন পুনরায় কিছু বলতেই বঙ্গবন্ধু বললেন, পাকবাহিনীও পারেনি ! তোমরা নিজেদের কী মনে করো ? বলেই তিনি দৃঢ় পদক্ষেপে সিঁড়ির দু'ধাপ নিচে নামলেন ।

বিচলিত মহিউদ্দিন থরথর করে কাঁপতে থাকে । তার হাতের স্টেনগান নিচে পড়ে যায় । ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মহিউদ্দিন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে একটু ঢোক গিলে আবার বলে, বঙ্গবন্ধু ! তারপর কাঁপা কাঁপা চাপা কন্ঠে বলে, আপনি আমাদের সঙ্গে আসুন ! আপনাকে নিয়ে যেতে বলা হয়েছে ।

বঙ্গবন্ধু আবার একই ধমকের স্বরে বললেন, কোথায় নিয়ে যাবে? কে নিয়ে যেতে বলেছে ?

মেজর মহিউদ্দিন কম্পিতকণ্ঠ বলে : জেনারেল জিয়া, স্যার !

বঙ্গবন্ধু আরেক ধাপ নিচে নামতেই কার যেন কান্নাচিৎকার ভেসে এলো, ওরা কামাল ভাইকে মেরে ফেলেছে-----

(চলবে-----)

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।