প্রবীর সিকদার


বঙ্গবন্ধু খুনের 'ধুরন্ধর বেনিফিসিয়ারি' মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাকশালেরও কম ভক্ত ছিলেন না ! বাকশাল গঠনের পর পাবনা জেলার গভর্নরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন অধ্যাপক আবু সাইয়িদ। ১৯ জুলাই, ১৯৭৫ জিয়া তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। চিঠিতে জিয়া লিখেছিলেন, ' প্রিয় অধ্যাপক সায়ীদ, পাবনা জেলার গভর্নর নিযুক্ত হওয়ায় আমার আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন। দোয়া করি যাতে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আপনার কর্মক্ষমতাকে উৎসর্গ করার জন্য আল্লাহ আপনাকে সাহস ও শক্তি দান করেন।' অথচ এই জিয়া বঙ্গবন্ধু খুনের পর পরই খুনি মেজর ডালিমকে পরম উষ্ণতায় জড়িয়ে ধরে ' কিস মি! কিস মি! ' বলে চিৎকার করেছিলেন ! কথাবার্তায় পাকিস্তানি সুর তুলে 'স্বাধীনতা', 'সার্বভৌমত্ব' আর 'ভারতীয় জুজু'র ভয় দেখানো শুরু করলেন 'বাকশাল প্রেমী' সেই জিয়া। দ্রুতই তিনি শফিউল্লাহকে সরিয়ে সেনা প্রধানের পদটি দখল করে নেন।

পিতা! তোমার অনুপস্থিতিতে তোমারই সুযোগ্য সহকর্মী তাজউদ্দীন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অজ্ঞাত কিংবা কৌশলগত কোনও কারণে তুমি তাঁকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলে। তোমার খুনি মেজর ডালিম তাজউদ্দীনের বাসায় গিয়ে তাঁকে 'প্রধানমন্ত্রী' পদ গ্রহণ করবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু তাজউদ্দীন ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ডালিমকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলেন। অথচ তোমার মন্ত্রী পরিষদে থাকা তোমারই 'আস্থাভাজন' আবু সাঈদ চৌধুরী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, ফনিভূষণ মজুমদার, মনোরঞ্জন ধর, আবদুল মোমেন, আসাদুজ্জামান খান, ড. এ আর মল্লিক, ড. মোজাফফর আহম্মদ চৌধুরী, আবদুল মান্নান, সোহরাব হোসেন, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, দেওয়ান ফরিদ গাজী, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ও কে এম ওবায়দুর রহমান খুনি মোশতাকের মন্ত্রী সভায় শপথ নেন! মুক্তিযুদ্ধের সেনানায়ক জেনারেল ওসমানীও হয়েছিলেন খুনি মোশতাকের উপদেষ্টা! তখনও ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে তোমার গাঢ় লাল তাজা রক্ত কি যেন বলে যাচ্ছিল !

একাত্তরের ঘাতক জামায়াত নেতা গোলাম আজম তখন জেদ্দায় দুই পাকিস্তানকে আবার এক করার 'লড়াই' সফল করতে চাঁদা তুলে বেড়াচ্ছিলেন। তোমার খুনের খবর পেয়েই উল্লসিত গোলাম বাংলাদেশের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দানের জন্য মুসলিম দেশগুলোর প্রতি উদাত্ত আহবান জানান।

পিতা! তোমাকে রক্ষা করতে এসে ওই কাল রাতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন একজন কর্নেল জামিল। তোমার রক্তের বদলা নিতে সেনা সদরে উদগ্রীব হয়েছিলেন একজন কর্নেল শাফায়াত জামিল। তোমার হাতে গড়া রক্ষী বাহিনী ঘটনাচক্রে হতবিহবল হয়ে পড়লেও তারা যখন বুঝতে পারে, এটা সেনা বিদ্রোহ নয়, তখনই তারা রুখে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিয়েছিল। শুধু নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল তারা। কিন্তু তোমার 'পরম আস্থাভাজন' সব শীর্ষ কর্তা, কি সেনা বাহিনীর কি রক্ষী বাহিনীর, 'নপুংশক' হয়ে যাওয়ায় প্রতিশোধের আগুন আর জ্বলেনি। 'অনুগত' আর 'আনুগত্য' প্রদর্শনের মহড়ায় তুমি তখন খুবই গৌণ! ক্ষোভের কোনও আগুন জ্বলেনি আমার হৃদয়েও। কী অকৃতজ্ঞ, কী কৃতঘ্ন সন্তান আমি !

পিতা মুজিব, আমায় ক্ষমা কর তুমি, ক্ষমা কর।