স্টাফ রিপোর্টার: 'অনেক ভিড়ের মধ্যে তুমি মুছে যাবে/ একথা যখন তুমি বলো/ দেখি পাহাড়ে পাহাড়ে কাশফুলবনে/ রৌদ্রতাপে প্রজাপতির পাখা জ্বলে। ' নিজের কবিতার মধ্যে দিয়েই যেন নিজের শেষ সময়ের কথাটি খুব সহজে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর।

যিনি একাধারে শিল্পী, শিক্ষক, কবি, ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিল্পনির্দেশক, গবেষক ও মুদ্রাতত্ত্ব বিশারদ।

শনিবার (১৫ আগস্ট) করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত অবস্থায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। তার মৃত্যুতে শোকের দিনেই যেন নেমে এসেছে আরো শোক।

৮৮ বছর বয়সী শিল্পী মুর্তজা বশির ১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং মরগুবা খাতুনের কনিষ্ঠ পুত্র তিনি। ১৯৪৯ সালে ঢাকা গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টসে (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট) দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি চারুকলা শিক্ষা শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে প্রথম বিভাগে পাস করেন। ১৯৫৫ সালে নবাবপুর সরকারি স্কুলে ড্রয়িং শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৬ সালে তিনি উচ্চতর শিক্ষার জন্য ইতালির ফ্লোরেন্সে যান এবং ১৯৫৮ সালের শেষদিকে লন্ডন হয়ে দেশে ফেরেন। ১৯৭৩ সালের আগস্টে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে। এরপর অধ্যাপক হিসেবে অবসর নেন ১৯৯৮ সালে।
চিত্রকলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ১৯৮০ সালে একুশে পদক পান মুর্তজা বশীর। একই কাজে স্বাধীনতা পুরস্কার পান ২০১৯ সালে। বাংলাদেশে বিমূর্ত ধারার চিত্রকলার অন্যতম পথিকৃৎ মুর্তজা বশীরের ‘দেয়াল’, ‘শহীদ শিরোনাম’, ‘পাখা’, ‘রক্তাক্ত ২১শে’ শিরোনামের চিত্রকর্মগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

চিত্রকলা ছাড়াও তার বিচরণ ক্ষেত্র ছিল সাহিত্য এবং চলচ্চিত্র অঙ্গনে। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৫ সালে শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম ইয়ুথ কয়ার প্রদত্ত একুশে মেলা পদক, ২০০৩ সালে সুলতান স্বর্ণপদক, ২০০৭ সালে কবি চন্দ্রাবতী স্বর্ণপদকসহ আরও বহু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেন তিনি। তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হলো: কাঁচের পাখির গান (১৯৬৯), এসরেণু (১৯৭৬), তোমাকেই শুধু (১৯৭৯), এসো ফিরে অনসূয়া (১৯৮৫) এবং নির্বাচিত রচনা মুর্তজা বশীর: মূর্ত ও বিমূর্ত (২০০১)।

বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার অন্যতম পথিকৃৎ চিত্রশিল্পী ও ভাষাসংগ্রামী মুর্তজা বশীর পেইন্টিং ছাড়াও ম্যুরাল, ছাপচিত্রসহ চিত্রকলার বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেছেন। ফিগারেটিভ চিত্রকলায় স্বতন্ত্র ভাষা তৈরি করলেও ‘জ্যোতি’ ও ‘কালেমা তাইয়্যেবা’ শীর্ষক গুরুত্বপূর্ণ চিত্রমালা তিনি এঁকেছেন। লিনোকাট মাধ্যমে ‘রক্তাক্ত ২১শে’ শীর্ষক তার আঁকা ছবিটি ভাষা আন্দোলন বিষয়ক প্রথম চিত্রকর্ম বলে গণ্য করা হয়। টেরাকোটা, মুদ্রা ও শিলালিপি নিয়েও তিনি গবেষণা করেছেন এই শিল্পী।

১৯৪৭ সালে নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি আকৃষ্ট হন বামপন্থী রাজনীতির প্রতি। কমিউনিস্ট পার্টি অফিসের জন্য মার্কস-অ্যাঙ্গেলস-লেনিনের ছবি আঁকতে আঁকতে অঙ্কনে হাতেখড়ি হয় তার। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও এই শিল্পীর ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ।

পড়াশোনার জন্য ইতালিতে থাকা অবস্থায় রেনেসাঁর ঐতিহ্য তাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে বলে তিনি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন। ইতালির পথে দেখা সাধারণ মানুষের ছবি তিনি এঁকেছেন। আরো এঁকেছেন অ্যাকর্ডিয়ান বাদক, জিপসির খেলা দেখানো, মা ও মেয়ের বাজার করে ফেরার দৃশ্য।

১৯৫৮ সালে ২৯ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল 'লা পার্মানেন্ট' গ্যালারিতে মুর্তজা বশীরের প্রথম একক প্রদর্শনী হয়। ১৯৬০-৬১ সাল থেকে লাহোরে বসে তিনি এঁকেছেন সিরিজ ছবি ‘দেয়াল’। ক্ষুব্ধ ও কম্পমান ভঙ্গুর রেখার রঙের নানা ক্যারিশমায় তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন ক্ষয়িষ্ণু সমাজ ব্যবস্থার কথা। আর ১৯৭৫ থেকে আঁকা ‘শহীদ শিরোনাম’ মুক্তিযুদ্ধে নিহত নাম না জানা শহীদদের উদ্দেশে নিবেদিত চিত্রমালা। এরপর ১৯৭৪-এ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে ইটের টুকরোর মোজাইকে আঁকেন দেয়ালচিত্র ‘শহীদ বৃক্ষ’।

জীবনের নানান প্রান্তে ক্যানভাসে নানা বিষয় নিয়ে এঁকেছেন তিনি। কোনো রং-রেখা আলাদাভাবে ব্যবহার না করে শুধু কাগজের টুকরো জোড়া দিয়ে কখনো আবার তৈরি করেছেন নানা কোলাজ। তবে আজ থেমে গেছে সব। হাজারো মৃত্যুর মধ্যে হয়তো মুছে যাবে শিল্পীও। তবে তার কর্ম আজীবন তার লেখা কবিতার মতো পাহাড় আর কাশফুলবনে রৌদ্রতাপে জ্বলবে প্রজাপতির পাখা হয়ে।

(ওএস/পিএস/১৫ আগস্ট, ২০২০)