মানিক সরকার মানিক, রংপুর : স্মরণকালের রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিতে জলে ভাসছে রংপুর। নদীতীরবর্তী এলাকাতো বটেই ডুবে আছে নগরীর ৩৩টি ওয়ার্ডের কমবেশি সড়ক পাড়া মহল্লার ঘরবাড়ি। এদিকে বৃষ্টির পানিতে বাসাবাড়ির আসবাবপত্রসহ সবকিছু তলিয়ে যাওয়ায় জেলা উপজেলায় জলবন্দী হয়ে পড়েছে অন্তত ৫ লাখ মানুষ। বাসায় থাকার মত অবস্থা না থাকায় অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও উঁচু স্থানে। শুধু ঘর বাড়ি নয়, পুকুর খাল বিলের মাছ ভেসে গেছে। মানুষজন চরম বিপাকে পড়েছে ঘরে থাকা শিশু বয়োবৃদ্ধ ও গবাদি পশু নিয়ে। তলিয়ে গেছে হাজার হাজার একর জমির আমন ধান ক্ষেতসহ আগাম শীতকালীণ শাক সবজি। বৃষ্টির পানির কারণে বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আসবাবপত্রের অন্তত কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। 

রংপুর আবহাওয়া দফতর জানায় শনিবার রাত থেকে রবিবার সকাল পর্যন্ত ১২ ঘন্টায় ৪৪৯ দশমিক ৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে তারা। স্থানীয় আবহাওয়া দফতরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজার রহমান এ পরিমাণ বৃষ্টিপাতকে স্মরণকালের বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বৃষ্টির পাশাপাশি ঘটেছে ভয়ংকর বজ্রপাতের ঘটনা। তবে তার মতে, বর্তমানে লঘুচাপ কিছুটা কমে যাওয়ায় আর বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা কম। এদিকে বৃষ্টির সাথে বজ্রপাতে জেলার গঙ্গাচড়ায় তাহের আলী (৪২) নামের এক এবং নগরীর মুলাটোল এলাকায় দেয়াল চাপায় অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।

প্রকৃতিতে শরতের মধ্যভাগ এখন। কিন্তু অসময়ে প্রকৃতির এই বৈরি আবাওয়ার কারণে গত কয়েকদিনে শরতের ছিটেফোটা ভাবও লক্ষ্য করা যায়নি। এ সময়টায় হালকা কুয়াশায় প্রকৃতি ঢাকা পড়ার কথা থাকলেও মাসজুড়েই চলছে কখনও হালকা কখনও ভারি বৃষ্টিপাত। লাগাতার এই বৃষ্টিপাতে ক’দিন ধরেই এ অঞ্চলে বিরাজ করছে এক ধরণের স্থবিরতা। এতে বিপাকে পড়ে কর্মজীবী মানুষ। কিন্তু শনিবার রাত ১২টার পর থেকে রবিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত চলা মুষুল ধারার বৃষ্টিপাত যেন অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। রাত বাড়ার সাথে সাথেই বৃষ্টি যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। এতে করে জলমগ্ন হয়ে পড়ে নদীতীরের এলাকা ছাড়াও শহর বন্দরের বিভিন্ন নিম্নাঞ্চলের ঘরবাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

রবিবার বিকেলে এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত নগরীর মুলাটোল, কোতয়ালী থানা চত্ত্বর, পালপাড়া, গোমস্তাপাগা, গুড়াতিপাড়া, গনেশপুর, জুম্মাপাড়া, দর্শণা, কামারপাড়া, মেডিকেল পূর্বগেট, শালবন, শালবন মিস্ত্রিপাড়া, মডার্ন মোড়, দক্ষিণ গুপ্তপাড়া, কামাল কাছনা, বৈরাগিপাড়াসহ অধিকাংশ পাড়া মহল্লা পানিতে ডুবে থাকতে দেখা যায়। এতে করে চরম ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখিন হয় অন্তত কয়েক লাখ মানুষ। নগরীর ৩৩টি ওয়ার্ডের বেশ কিছু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে জলমগ্নতার করুণ চিত্র।

শহরের প্রাণকেন্দ্র সমাজ কল্যাণ বিদ্যাবিথী, গণেশপুর উচ্চ বিদ্যালয়, বুড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জলমগ্ন পরিবারগুলো তাদের আসবাবপত্র ও গরু ছাগল নিয়ে আশ্রয় নিয়ে আছে। রংপুর মহানগরীর বুকচিড়ে যাওয়া পয়: নিষ্কাষণের একমাত্র শ্যামা সুন্দরী খালটি গত কয়েকদিন ধরে পানিতে টইটুম্বর হয়ে পড়ায় দু’পাশের পরিবারগুলোর ভোগান্তি যেন চরমে উঠেছে। এসব এলাকার অনেকেই সরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে আত্মীয়র বাসায় কিংবা পাশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। কোথাও কোথাও পানিবন্দী মানুষদের সরিয়ে নিতে ফায়ার সার্ভিসের দলকে কাজ করতে দেখা গেছে।

নগরীর সেনপাড়া শ্যামাসুন্দরী খাল সংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী আমেনা বেগম, আনোয়ার হোসেনসহ অনেকেই জানান, এমন বৃষ্টির পানি তারা ৮৮ সালের বন্যার পর এই প্রথম দেখলো। এদিকে গত দু’বছরে জাইকার অর্থায়নে সিটি করপোরেশন কয়েক’শ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর অধিকাংশ এলাকায় ড্রেন নির্মাণ করলেও বিন্দুমাত্র ড্রেনেজ সুবিধা পাচ্ছে না নগরবাসী। সড়কের পানি ড্রেন দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ড্রেনের সাথে ফুটো রয়েছে, সেগুলো শুরু থেকেই বন্ধ থাকায় এবং সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ সেসব সঠিক তদারকি না করায় নগরজুড়ে এই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। রবিবার এ ব্যাপারে সিটি মেয়রের সাথে মুঠোফোনে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

(ওএস/এসপি/সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২০)