আবীর আহাদ


অর্থের লালসা, আত্মীয়প্রীতি ও দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার ও রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দিয়ে বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম অধ্যায় 'মুক্তিযুদ্ধ'কে চরমভাবে বিতর্কিত করার কার্যক্রমে যারা জড়িত তারা জঘন্যতম রাষ্ট্রদ্রোহিতার কাজটি করছেন । এদের খুঁজে বের করা মোটেই কঠিন নয় । দরকার সরকারের সদিচ্ছা ।

গত বছর মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়ন ও রাজাকার তালিকা প্রকাশ নিয়ে সারা দেশে যে তুমুল ধুম্রজাল ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিলো, এসবের বিরুদ্ধে বহুদিন পূর্ব থেকেই আমি একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ব্যানারে বাদপ্রতিবাদ করে আসছি । আমরা আশা করেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী দল আওয়ামী লীগ সরকার অন্ততঃ আমাদের কথাগুলো একটু পর্যালোচনা করে দেখবেন । আমরা এও বলে আসছি যে, বর্তমান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ তথা মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না । উপরন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাই ভুলুণ্ঠিত হবে । শেখ হাসিনা সরকারের বদনাম হবে । পরিশেষে তাই হয়েছে ।

আমরা বলে আসছি, বাহাত্তর সালের বঙ্গবন্ধু সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে কোনো অবস্থাতেই মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দেড় লক্ষের বেশি হবে না । অথচ বঙ্গবন্ধুর সেই সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে নানান গোঁজামিলের সংজ্ঞায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে ইতোমধ্যেই মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় দু'লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজারের মতো মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত হয়েছেন, যার আশি/পঁচাশি হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা----এমনকি রাজাকারদেরও মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়া হয়েছে ! আর এ-গোঁজামিলের তালিকার পশ্চাতে বিশাল অর্থ, আত্মীয়প্রীতি ও রাজনৈতিক সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে । এছাড়া মুক্তিযুদ্ধকে নতুন প্রজন্মের কাছে বিতর্কিত করার মহলবিশেষের চক্রান্তও কাজ করছে ।

হালের রাজাকার তালিকা প্রকাশও ঐ একই অর্থ, আত্মীয়প্রীতি ও রাজনৈতিক সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করছে বলে প্রতীয়মান হয় । দেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল, প্রজাতন্ত্রের প্রশাসন ও আর্থিক খাতসমূহে রাজাকার চেতনার লোকদের রমরমা অবস্থান । রাজাকার তালিকার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ঢোকানোর পাশাপাশি রাজাকার খাতায় প্রকৃত রাজাকারদের নাম প্রকাশ না-করার মাধ্যমে দেশের ভেতর একটি বিশৃংখল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা গেলে সরকার হয়তো এই বিশৃংখলা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য রাজাকার তালিকা প্রকাশ স্থগিত করে দিতে পারে----এ-লক্ষ্যে হয়তো পর্দার অন্তরালে লুক্কায়িত রাজাকার চেতনার লোকজন এ-ধরনের জগাখিচুড়িপনা তালিকা প্রণয়ন করে থাকতে পারে । এর মধ্য দিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার চক্রান্ত করছে ।

মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের তালিকা প্রণয়ন করা মোটেও দুরূহ নয় । বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাকে সামনে রেখে যদি একটি উচ্চপর্যায়ের বিচারবিভাগীয় মুক্তিযোদ্ধা তদন্ত কমিশন গঠন করে, একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি/সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতির নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, সাবসেক্টর কমান্ডার, চাকরিরত সেনা-নৌ-বিমান-পুলিশ বাহিনীর একজন করে উচ্চপর্যায়ের সদস্য সমন্বয়ে কেন্দ্রীয় তদন্ত কমিশন এবং উপজেলাভিত্তিক একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ/ জেলা জজের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধকালীন সুপরিচিত দু'জন থানার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, সেনাবাহিনীর চাকরিরত মেজর পদমর্যাদার সেনা-নৌ-বিমান-RAB-পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে প্রতি উপজেলায় একটি করে মুক্তিযোদ্ধা তদন্ত কমিশন গঠন করে, মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন অস্ত্র প্রদর্শনার্থে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই করা হলে সেই যাচাই বাছাই কমিশনের সামনে নৈতিকভাবে দুর্বল ও ভীরু কোনো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হাজিরই হবে না । তদন্তকালীন ভুয়া প্রমাণিত হলে তাৎক্ষনিক রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আওতায় কঠোর শাস্তি প্রদান করতে হবে । উপজেলা তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর বিচার-বিশ্লেষণ করে কেন্দ্রীয় তদন্ত কমিশন মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রস্তুত করে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেবেন । মহামান্য রাষ্ট্রপতি অত:পর মুক্তিযোদ্ধা তালিকার চূড়ান্ত আইনীভিত্তি প্রদানের জন্য জাতীয় সংসদে পেশ করবেন । এভাবেই মুক্তিযোদ্ধা তালিকার চূড়ান্ত অবসান ঘটাতে হবে ।

একই ধরনের আরেকটি বিচার বিভাগীয় রাজাকার যাচাই বাছাই কমিশন গঠন করে উপজেলাভিত্তিক রাজাকার আলবদর আলশামস আলমুজাহিদ ও শান্তি কমিটির সরকারি মহাফেজখানা থেকে প্রাপ্ত তালিকাসহ প্রতি ইউনিয়নের একজন মুক্তিযোদ্ধা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নিকট থেকে রাজাকারের তালিকা সংগ্রহ করতে হবে । ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা ও চেয়ারম্যান মিথ্যা তথ্য দিলে তাদের কঠোর শাস্তির বিধানে বিচারের ব্যবস্থা থাকবে । রাজাকার তালিকাও জাতীয় সংসদের মাধ্যমে আইনীভিত্তি দিয়ে চূড়ান্ত অবসান ঘটাতে হবে ।

দু'টো তদন্ত কমিশন একই সময়ে পাশাপাশি অবস্থানে থেকেও তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে । মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের তালিকা প্রণয়ন নিয়ে ইতিমধ্যেই দীর্ঘ ঊনপঞ্চাশটি বছর অতিবাহিত হয়েছে ।
এ-প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের তালিকা প্রণয়ন না-হয় আরো একটি বছর ব্যয় হলো----তাতে নিশ্চয়ই জাতীয় স্বার্থে সবাই মেনে নেবে । তবে আমার বদ্ধমূল ধারণা, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এ-দু'টি প্রকল্প বাস্তবায়ন ছ'থেকে ন'মাসের মধ্যেই সম্পন্ন করা অবশ্যই সম্ভব ।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত হবে । বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ও চেতনা বাস্তবায়নের জন্য রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, শিল্প ও বাণিজ্য, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় প্রভৃতি অঙ্গন থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতারবিরোধী উচ্ছেদ করতে হবে । এভাবেই বঙ্গবন্ধু ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।