আবীর আহাদ


জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দু:খ করে বলেছেন : "আগাছাগুলিকে আমার বড় ভয় । এগুলি না তুললে আসল গাছগুলি ধ্বংস হয়ে যাবে । যেমন আমাদের দেশের পরগাছা রাজনীতিবিদ, যারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক তাদের ধ্বংস করে এবং করতে চেষ্টা করে ।" কারাগারের রোজনামচা : শেখ মুজিবুর রহমান । পৃষ্ঠা- ১১৭।

জাতির পিতার কথার সূত্র ধরে আমিও একথা বলতে চাই যে, মুক্তিযোদ্ধা অঙ্গন থেকে অ-মুক্তিযোদ্ধা নামক আগাছাগুলো উৎপাটিত করতে না পারলে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস চেতনা শৌর্য বীর্য ত্যাগ বীরত্ব ও মর্যাদা ধ্বংস হয়ে যাবে । মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অপমৃত্যু ঘটবে । আর এভাবেই এতো রক্তমূল্যে কেনা আমাদের স্বাধীনতা মূল্যহীন হয়ে পড়বে ।

এ-পরিপ্রেক্ষিতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ঐতিহাসিক অবদানের মূল্যায়ন ও অমুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে আমরা একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের গোড়াপত্তন করে 'বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা'র দাবিতে আজ প্রায় তিন বছর যাবত মাঠে, ময়দানে, প্রেসক্লাবে, পদযাত্রায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে স্মারকলিপি পেশসহ ধারাবাহিক লেখা ও বিবৃতির মাধ্যমে এক অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে আসছি ।

আমাদের এসব দাবির ন্যায্যতা অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধু-কন্যার সরকার ও আওয়ামী লীগ গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে তাদের দলীয় ইস্তাহারে 'মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও মর্যাদা পুন:প্রতিষ্ঠা'র অঙ্গীকার করেন । সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের কোনোই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না । উপরন্তু জামুকা নামক সংস্থাটি একটি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার ওপর নির্ভর করে যাকে-তাকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েই চলেছে । আমরা আগেই বলেছি, " মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি যিনি যেকোনো একটি ফোর্সের সদস্য হিশেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন"----- বঙ্গবন্ধু সরকারের বাহাত্তর সালের ঐ মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে একটি উচ্চপর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা যাচাই যাচাই কমিশন গঠন করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সঠিক তালিকা প্রণয়ন করতে হবে । অন্যথায় অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় গোঁজামিল সংজ্ঞায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটবে, কিন্তু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নিরূপণ করা যাবে না ।

কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, এমন একজন লোককে আমরা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিশেবে পেয়েছি, যিনি এ-বিষয়ে কীভাবে কী করতে হবে, তার কিছুই বোঝেন বলে মোটেও মনে হয় না ! অপরদিকে তাঁরই নেতৃত্বে জামুকা নামক যে সংস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে, তার কর্মকর্তাদেরও এ-বিষয়ে কোনো ধারণা ও মাথা ব্যথা আছে বলেও মনে হয় না । অ-মুক্তিযোদ্ধা বিতাড়নের বিষয়ে দেশে যে একটা প্রবল দাবি উঠেছে, সে-ব্যাপারে তাদের কোনো চৈতন্য নেই । প্রায় আশি / পঁচাশি হাজার অ-মুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকারদেরও মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় রেখে দেয়ায় তারা যে সরকার তথা রাষ্ট্রের অর্থ ও অন্যান্য সুবিধাদি হাতিয়ে নিচ্ছে, অকারণে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বে ভাগ বসিয়ে চলেছে----এসব বিষয়ে তাদের কোনোই বিবেচনা নেই । তাদের বিবেকেও বাধে না । এসব বিষয়ে যারা সঠিক পরামর্শ দিতে পারে, তাদের সহযোগিতা নিতেও তাদের দেখা যাচ্ছে না । মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে ভুয়ামুক্ত করবে কি, তারা বরং নানান গোঁজামিলের সংজ্ঞা আবিষ্কার করে ভুয়াদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে চলেছেন । এর মূলে রয়েছে অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনা । বলা চলে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা একটি নপুংসক আত্ববিনাশী গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছি । অপরদিকে রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরাও এ-ব্যাপারে একেবারেই নির্লিপ্ততা ! মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়ে তাদের কোনোই মাথাব্যথা নেই । তারা আছে, কীভাবে ক্ষমতায় থাকা যায় আর অবাধে লুটপাট করা যায় । ফলে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে তাদের মনে কোনো আবেদন সৃষ্টি হয় না !

বীর মুক্তিযোদ্ধারা আজ জীবনের শেষপ্রান্তে অবস্থান করছেন । অবহেলায় অনাদরে ও মর্যাদাহীন অবস্থায় প্রতিদিন পাঁচ/ছ'জন করে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছেন । অধিকাংশই রোগে শোকে বয়সের ভারে নুয়ে থেকে চরমতম মানবেতর জীবনযাপন করছেন । স্বাধীনতার সুফল ভোগকারীরা কি একটিবার ভেবে দেখেছেন, মুক্তিযোদ্ধারা তাদের জীবনের বিনিময়ে দেশটাকে স্বাধীন করেছিলো বলেই যিনি জীবনে যা কল্পনাও করেননি, তিনি তাই হয়েছেন, হচ্ছেন ও হবেন ! অথচ সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নূন্যতম মৌলিক অধিকার ও তাদের জাতীয় মর্যাদা নিশ্চিত করতে কারো কোনো মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হয় না । এতোটা অবিবেচক ও অকৃতজ্ঞ কি কোনো মানুষ হতে পারে ?

আসলে যে জাতি বা যারা তাদের জাতীয় বীরদের মর্যাদা ও অবদানের বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকে, সেই জাতি বা তারা ভবিষ্যতে কোনো জাতীয় বীরদের আগমন আশা করতে পারে না । বঙ্গবন্ধু ঠিকই বলে গেছেন, আগাছা-পরগাছাগুলো দেশকে ধ্বংস করে দেয় । আমাদের দেশের আগাছা নামক অ-মুক্তিযোদ্ধা ও পরগাছা নামক ক্ষমতাবান ও লুটেরা অমানুষগুলো দেশ ও জাতির ইতিহাস চেতনা ও মর্যাদাকে ধ্বংস করে চলেছে । জাতীয় স্বার্থে এসব সুযোগসন্ধানী ও চাটারদলকে সমাজ ও রাষ্ট্রদেহ থেকে উৎপাটিত করতে হবে ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।