রাণীশংকৈল প্রতিনিধি : ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলায় দুই শিশুসহ মায়ের লাশ উদ্ধারের পর তাদের বাড়ি থেকে দুই পৃষ্টার একটি চিরকুট মিলেছে। যাতে লেখা ছিল- নিজেই আত্মহত্যা করিলাম- আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নই। এটা সত্যি একশবার, একশবার, একশ বার। শনিবার (১৭ অক্টোবর) সকালে চিরকুট উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন থানার ওসি এসএম জাহিদ ইকবাল। তবে এ বিষয়ে এখনো কোন মামলা হয়নি বলে জানান ওসি। এদিকে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে চিরকুট অনুযায়ী যদি এটি আত্মহত্যা হয়। তাহলে লাশগুলো বাড়ী থেকে মাত্র ১৫ হাত দুরে কিভাবে ডোবায় গেলো?

গত বৃস্পতিবার সকালে জেলার রানীশংকৈল উপজেলার ধর্মগড় ইউনিয়নের ভরনিয়া শিয়ালডাঙ্গী গ্রামে বাড়ির সামনে একটি ডোবায় আরিদা বেগম (৩০) মেয়ে আখলিমা আখতার আঁখি (১০) ছেলে আরাফত হোসেন (৪) এর লাশ ভাসতে দেখে স্থানীয়রা। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের লাশ উদ্ধার করে।

ঘটনাটি রহস্যজনক হওয়ায় ঘটনাস্থলে সিআইডি, পিবিআই, র‌্যাব-১৩ ও পুলিশ তদন্ত করে। ঘটনার দিন বিকেলে নিহত আরিদার শয়ন ঘর থেকে তার মেয়ের স্কুলের একটি খাতায় চাপা দেওয়া অবস্থায় দুই পৃষ্টার একটি চিরকুট উদ্বার হয়।

ওসি এসএম জাহিদ ইকবাল বলেন, উদ্ধারকৃত দুই পৃষ্ঠার চিঠিতে নিহত আরিদা বেগম লিখে গেছেন, আহারে জীবন, সংসারের অভাব, অশান্তি আর ভালো লাগে না। আমি একাই চলে যেতাম, কিন্তু আমি একা গেলে আমার বাচ্চারা মা মা বলে হাহাকার করবে। এজন্য ওদের নিয়েই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে আমরা মারা যাওয়ার পরে আমাদের তিনজনের কবর এক সাথে দিও বলে চিরকুটে উল্লেখ্য করেন।

ওসি চিরকুটের বরাতে আরো জানান, আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী না। আমি নিজেই আত্মহত্যা করিলাম। এটা সত্যি একশ বার, একশবার, একশ বার। চিরকুটে নিহত আরিদার স্বামী আকবরকে উদ্দেশ্যে করে লেখা হয়, স্বামী তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নাই। আমার বিয়ের মোহরানা মাফ করে দিলাম। তুমি ভালো থেকো। শ্বশুড়বাড়ির লোকজনকে উদ্দেশ্যে করে আরিফা আরও লিখে গেছেন, আপনাদের সঙ্গে অনেক খারাপ আচরণ করেছি, এজন্য মাফ চাই।

ওসি আরো জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা অভাব অনটন ও সংসারে অশান্তি ছিলো আরিদার। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে হতাশা ও বিষন্নতায় ভুগছিলেন তিনি। তাই মেয়ে ও ছেলেকে বিষাক্ত কোনো কিছু খাইয়ে পরে নিজে আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন। তবে আমরা নিশ্চিত না। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলেই, মৃত্যুর আসল রহস্য জানা যাবে।

এদিকে দুই শিশুসহ মায়ের লাশ উদ্ধারের পর স্বামী আকবর আলী, শ্বশুর সিরাজুল ইসলাম, শ্বাশুড়ী মনোয়ারা বেগম ও দেবর বাবর আলীকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসার জন্য আটক করা হয়েছিল। পরে তাদের স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য ও এলাকার ওগণ্যমান্য ব্যক্তিদের হেফাজতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন ওসি এস এম জাহিদ ইকবাল।

নিহত আরিদার স্বামী আকবর আলী সাংবাদিকদের জানান, অভাব অনটনের সংসারে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া-বিবাদ হয়েই থাকে। তিনি বলেন, গত মঙ্গলবার বে-সরকারী সংস্থা ব্র্যাক থেকে ১৪ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। এর পরে গত বুধবার সন্ধায় আমার বাবার সাথে আমার ব্যক্তিগত লেনদেন নিয়ে কথাকাটি হয়। আমার বাবার সাথে কথাকাটির শেষে আমার স্ত্রী আরিদা বলেন, তোমার এত ঋণ পরিশোধ করবা কিভাবে। এত ঋণ আমার ভাল লাগে না। আমি তোমার বাসায় থাকবো না। তবে আমি যেখানে যাই আমি ছেলে-মেয়েকে সাথে করেই নিয়ে যাবো। আকবর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, কিন্তু সে এভাবে আমাকে ছেড়ে আমার ছেলে মেয়েদের নিয়ে চলে যাবে,তা বুঝিনি।

ধর্মগড় ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য মাইনুদ্দিন হোসেন ও স্থানীয়রা জানান, আরিদার স্বামী আকবর ফেরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কোভিড-১৯ এর কারণে বেশ কয়েক মাস ব্যবসা বন্ধ ছিল। বর্তমানে তাঁর ব্যবসা ভালো যাচ্ছিলো না। এতে সংসারে অভাব দেখা দেয়। অভাব-অনটনের কারণে আকবর ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন। এসব নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি হতো। ঘটনার দিনও বাবার কাছ থেকে নেওয়া টাকা ফেরত নিয়ে আকবরের সঙ্গে তাঁর বাবার ঝগড়া হয়। সে সময় আরিফা স্বামীর পক্ষ নিয়ে শ্বশুড়ের সঙ্গে ঝগড়াও করেন। পরে এ ঘটনা নিয়ে আকবর ও আরিফার মধ্যেও ঝগড়া বেঁেধ যায়। এই ঝগড়ার জেরেই এ সিদ্বান্ত নিতে পারে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। আত্মহত্যার আগে আরিদার লেখা চিরকুট উদ্ধারের পর পুলিশ সেই চিরকুটের লেখা পড়ে শোনান । চিঠিতে তাদের সংসারে অভাব অনটনের কথা উঠে এসেছে।

ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা: রকিবুল আলম চয়ন বলেন, শুক্রবার দুপুরে আরিফা বেগম, তার দুই সন্তান আখলিমা আখতার ও আরাফাত হোসেনের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। প্রতিবেদনের জন্য সংগ্রহকৃত নমুনাগুলো রাজশাহীর ক্রাইম ইনভেশটিকেশন ডিপার্টমেন্টে পাঠানো হবে। সেখানে পরীক্ষা-নীরিক্ষা শেষে রিপোর্ট পাওয়া যাবে। এরপর এই মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে।

অফিসার ইনর্চাজ(ওসি) এস এম জাহিদ ইকবাল বলেন, চিরকুটের লেখা আমরা প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছি,এটি নিহত আরিদার কিনা। পাশাপাশি লাশ তিনটি কিভাবে বাড়ী থেকে ডোবায় এলো। তাও তদন্ত করছি। তাছাড়াও ডোবাটির সমস্ত পানি তদন্তের স্বার্থে ছেঁেকও দেখা হয়েছে। এতে কিছু পরিত্যক্ত বোতল, মরা কয়েকটি মাছ পাওয়া গেছে। পরিশেষে ময়নাতদন্তের রির্পোটের উপরই সব কিছু নির্ভর করছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, উদ্ধার করা চিঠিটি আরিদার নিজের লেখা কিনা তা নিশ্চিত করে আমরা যাচাই করছি। সবকিছু মিলিয়ে আমরা এ বিষয়টি গুরত্ব সহকারে তদন্ত করছি।

(কেএস/এসপি/অক্টোবর ১৭, ২০২০)