আবীর আহাদ


এটা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ । ত্রিশ লক্ষ শহীদের পবিত্র রক্তস্নাত বাংলাদেশ । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপরিসীম শৌর্য ত্যাগ ও বীরত্বে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ । সেই বাংলাদেশ সাগরসম দুর্নীতি লুটপাট ও মাফিয়াতন্ত্রে ডুবে হাবুডুবু খাচ্ছে । দিক হারিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরপাক খাচ্ছে ।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকার হারিয়ে যাচ্ছে । সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র সীমাহীন অব্যবস্থা ও অস্থিরতা বিরাজ করছে । মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক মূল্যবোধে চরম অবক্ষয় ঘটেছে । অনৈতিক আর্থসামাজিক ও দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অশুভতার ফলশ্রুতিতে সামাজিক মনোজগতে নির্দয় ও নিষ্ঠুর অপরাধপ্রবণতা জেকে বসেছে । এর প্রভাবে পারিবারিক সামাজিক ও জাতিগত জীবনে অবিশ্বাস ও হানাহানি সৃষ্টি হয়েছে । বন্ধ হয়ে যাচ্ছে মানুষের সুকুমার মনোবৃত্তির সব দুয়ার ।

জাতির নৈতিক চরিত্রের স্তর এতোটাই নিচে নেমে গেছে যে, স্বাধীনতার মাত্র কিছুকালের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলে গেলো ! বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান শুধু ভুলেই যায়নি, তাদের বীরত্বের অবদানকে অবমূল্যায়ন করে আসছে । তাদের প্রতি হিংসায় জ্বলে তাদের বীরত্বে ভাগ বসানোর জন্য দলে দলে রাজাকারসহ অমুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে । এসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকার প্রচ্ছন্ন সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে । মুক্তিযোদ্ধা বানানোর পশ্চাতে কাজ করছে বিপুল অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক দলীয় স্বার্থ । মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গনে আজ ভুয়া/অমুক্তিযোদ্ধা, ভুয়ার কারিগর ও হালের জামুকা একটি অভিশাপ হয়ে বিরাজ করছে । এরাও মাফিয়াচক্রের প্রতিনিধি । এখানেও রাঘব বোয়ালরা জড়িত ।

এসবের মূলেই রয়েছে সমাজ-রাষ্ট্রে দুর্নীতিবাজ লুটেরা রাজনৈতিকদুর্বৃত্ত ও মাফিয়াচক্রের জঘন্যতম ক্রিয়াকলাপ । এ-চক্রকে উচ্ছেদ করতে না পারলে আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মূল্যহীন হয়ে পড়বে ।

আজকে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে সরকারের যে পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাকে সাধু জানিয়ে বলছি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যখন অভিযান পরিচালনাই করছেন তখন দুর্নীতির নিচুস্তর তো বটে, উপরিস্তরেও সমানতালে চালাতে হবে । দুর্নীতি বলেন, লুটপাট বলেন, মাফিয়াতন্ত্র বলেন-----এসবের শুরু উপর থেকেই । এসবের গডফাদাররা উপরেই অবস্থান করে । সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের প্রণয়ক, প্রকল্পের অনুমোদক ও প্রকল্পের পরিচালক----এরাই দুর্নীতি ও লুটপাটের হোতা । এরাই কোনো দশ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় একশ' কোটি দেখায়, এরাই এক হাজার টাকার একটি নারকেল গাছ ক্রয়ব্যয় দেখায় নয় লক্ষ টাকা ! এরাই এক হাজার কোটি টাকার ব্রিজ প্রকল্পের ব্যয় দশ হাজার কোটি টাকা দেখিয়ে লুটপাট করে । এসব দুর্নীতিবাজ লুটেরাদের নিকট থেকে কমিশন খেয়ে সরকারের উঁচুস্তরের ক্ষমতাশালীরা তথা গডফাদাররা তাদেরকে আশ্রয় প্রশ্রয় ও নিরাপত্তা দেয় । মূলত: গডফাদারদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে নিচের চুনোপুঁটি থেকে রাঘব বোয়ালগুলোর জন্ম । এজন্য বঙ্গবন্ধু নিজেও বলে গেছেন : দুর্নীতি আমার কৃষক করে না, দুর্নীতি আমার শ্রমিক করে না, দুর্নীতি করে শিক্ষিতরা; সমাজের উপরতলার লোক----

সেদিন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ইব্রাহিম খালেদ একটা সুন্দর, তাৎপর্যপূর্ণ ও যুক্তিযুক্ত কথা বলেছেন । তিনি বলেছেন, ক্যাসিনো সম্রাট ধরেছেন, ব্যাংকিং সম্রাটকেও ধরুন । এ কথার মধ্য দিয়ে তিনিও বুঝাতে চেয়েছেন যে, দুর্নীতি লুটপাট ও মাফিয়াতন্ত্রের চুনোপুঁটিদের পাশাপাশি এসবের মহাদানব রাঘব বোয়ালদের ধরতে হব----বিনাশ করতে হবে ।

সুতরাং ঢাকঢোল পিটিয়ে দু'-চারজন চুনোপুঁটিকে ধরা হলে রাঘব বোয়ালদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয় । অথবা তারা সরকারের এ অভিযানকে নস্যাত্ বা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চক্রান্তের জাল বুনতে নানান তৎপরতা করতে পারে । সরকার যদি এ দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে ঢিলেঢালা বা চুনোপুঁটি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখে তাহলে জনমনে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, ফলশ্রুতিতে জনমত সরকারের বিপক্ষে প্রবাহিত হবে, যা সরকারের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।