স্টাফ রিপোর্টার : পাড়া ও মহল্লার দোকান থেকে শুরু করে নামী-দামি বেকারিতে বিক্রি হচ্ছে বিস্কুট, চানাচুর, নিমকি, সিঙ্গারা, সমুচা, রুটি, পাউরুটি, মিষ্টি, সন্দেশ-ইত্যাদি নানা বাহারি খাবার। সাধারণ মানুষ কখনো কি ভেবে দেখেছে  এই খাবারগুলো কোত্থেকে আসছে? কোথায় তৈরি হচ্ছে? কি দিয়ে তৈরি হচ্ছে এসব খাবার? এসব খাদ্যপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ও যাচাই-বাছাই করার দায়িত্বে যারা আছেন তারা কি তাদের দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করছেন? 

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব খাদ্যপণ্য যেসব প্রতিষ্ঠানে তৈরি হচ্ছে তার বেশির ভাগের নেই কোনো বৈধ লাইসেন্স ও বিএসটিআইর অনুমোদন। স্যাঁতস্যাঁতে নোংরা পরিবেশে ভেজাল ও অতি নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে অবাধে তৈরি করা হচ্ছে বেকারি সামগ্রী।

তাছাড়া মহামারী করোনা ভাইরাসের কারনে যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তা লাঘব করার জন্য অতি মাত্রায় বেড়েছে শিশু শ্রম। কারখানা আইন (১৯৬৫) আনুযাী ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ১৪ বছরের কমবয়সী ব্যক্তিকে নিয়োগদান নিষিদ্ধ করেছে এবং শিশু ও কিশোরের জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কাজের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রবিধান দিয়েছে। এছাড়া এই আইন কোন কারখানায় নারী শ্রমিকদের ৬ বছরের নিচে সন্তানদের লালন-পালনের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির নির্দেশ দিয়েছে।

উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ ছাড়াই বাহারি মোড়কে বনরুটি, পাউরুটি, কেক, বিস্কুট, পুডিংসহ বিভিন্ন ধরনের বেকারি সামগ্রী উৎপাদন ও বাজারজাত করা হচ্ছে। বিএসটিআই ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে মাঝেমধ্যেই এসব কারখানায় ভেজালবিরোধী অভিযান চালিয়ে জেল-জরিমানা করা হয়। কিন্তু তারা আইনের ফাঁক গলিয়ে ও প্রভাবশালীদের কারনে ফের ভেজাল সামগ্রী দিয়ে অবাধে এসব বেকারি সামগ্রী তৈরি করে খোলা বাজারে সরবরাহ করে আসছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভেজাল কেমিক্যাল ও নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে তৈরি করা এসব বেকারি সামগ্রী খেলে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি হতে পারে। পেটব্যথা, বমি, শরীর দুর্বলসহ জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি রয়েছে। তারা বলেছেন, মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর এসব ভেজাল খাদ্য উৎপাদন বন্ধ করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর ৪৯টি থানা এলাকায় নামে-বেনামে অন্তত তিন হাজার বেকারি সামগ্রী তৈরির কারখানা রয়েছে। মোহাম্মাদপুর মেট্রো হাউজিং এর ভিতরে রয়েছে পাশাপাশি দুটি বেকারি টি এইচ ও হযরত গোলাপ শাহ ব্রেড এন্ড বেকারি, পুরান ঢাকার লালবাগের আজিমপুর ছাপরা মসজিদ রোডের পশ্চিমে শেখসাহেব বাজার আমতলা মোড়ে রয়েছে নিউ মালেক বেকারি, মালেক বেকারি। শহীদনগরে রয়েছে, আয়েশা-আছমা ফুড প্রডাক্টস, কাজল বিস্কুট ফ্যাক্টরি, আমলিগোলা পাইপ কারখানা সংলগ্ন বেঁড়িবাঁধ ঢালে রয়েছে হক বেকারি। নবাবগঞ্জ রোডে হৃদয়, বেকারি, সানু বেকারি ও নবাবগঞ্জ বাজারের নবারুণ কাববাড়ী রোডের ঢালে রয়েছে পুষ্টি ব্রেড ফ্যাক্টরি, চাঁদপুর বেকারি, কামরাঙ্গীরচরের মধ্য রসুলপুর কমিউনিটি সেন্টার রোডে রয়েছে প্রিয় ফুড প্রডাক্টস, হাজারিবাগ পার্কের ঢালে রয়েছে বিকল্প বেকারি, হাজারিবাগ বৌ-বাজারে রয়েছে আরো পাঁচ-ছয়টি বেকারি কারখানা।

মোহাম্মদপুরের শেরেবাংলা রোডের কাটাসুর ৬৩-আইয়ে রয়েছে খাজা ফুড প্রডাক্টস, একই এলাকার ৬৩-এইচে রয়েছে মধুমিতা বেকারি, তারা বেকারি, তৃপ্তি বেকারি, মিতা ফুড প্রডাক্টস, খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ার ১৯ নম্বর রোডের ৬৩-এ নম্বর বাড়িতে রয়েছে নিউ তিতাস বেকারি, ঝিগাতলা গাবতলা মসজিদের একটু সামনে নাম ছাড়াই একটি কারখানায় তৈরি হচ্ছে বেকারি পণ্য। মিরপুর ১০ নম্বর কাঁচাবাজারসংলগ্ন বাদল ব্রেড ফ্যাক্টরি, আমান ব্রেড ফ্যাক্টরি এবং ইসলাম ব্রেড ফ্রাক্টরিসহ এই এলাকার বেশকিছু কারখানায় নোংরা পরিবেশে তৈরি হচ্ছে খাদ্যপণ্য।

কারখানাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, হ্যান্ডগ্লাভস ছাড়াই স্যাঁতস্যাঁতে ও নেংরা পরিবেশে বিভিন্ন পণ্য তৈরি হচ্ছে। এভাবে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে অসংখ্য বেকারি ও খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান।

ঝিগাতলা গাবতলা মসজিদসংলগ্ন রাজ বেকারির কারখানার এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দিনের বেলায় তারা কোনো পণ্য উৎপাদন করেন না। ফজরের আগেই পণ্য উৎপাদন শেষ হয়ে যায়। রাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং পুলিশের ঝামেলা একটু কম বলেই পণ্য উৎপাদন রাতেই শেষ করে থাকে। ফজরের পরই কোম্পানির ভ্যানে বিভিন্ন এলাকার পাড়া-মহল্লা ও অলিগলির জেনারেল স্টোর ও চায়ের দোকানে ওই সব পণ্য পৌঁছে দেন ডেলিভারিম্যানরা।

সেকশন বেড়িবাঁধের ঢালে এক চায়ের স্টলে গিয়ে দেখা গেছে, বিকল্প বেকারির মোড়কে একাধিক পলি প্যাকেটে ঝুলছে পাউরুটি, বাটারবন, কেক, পেটিস, সিঙ্গারাসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্য। বিকল্প বেকারির উৎপাদিত বেকারি সামগ্রী পাউরুটিসহ অন্যান্য খাদ্য সামগ্রীর মোড়কে বিএসটিআই, বিডিএস-৩৮২ নম্বর লেখা রয়েছে। মোড়কের গায়ে উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণ লেখা থাকলেও কত তারিখে উৎপাদন হয়েছে বা মেয়াদ শেষ হবে কবে তার উল্লেখ নেই।

চা দোকানির কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা গরিব মানুষ, ফুটপাথে চা-পান বিক্রি করে সংসার চালাই, উৎপাদনের তারিখ দেখার সময় নাই, কাস্টমাররা তো আর এসব জিজ্ঞেস করে না। প্যাকেট থেকে কোনো মতে তুলে চা বা কলা দিয়ে খেতে ওই সব বেকারি সামগ্রী কিনে নিচ্ছে। একপর্যায়ে ওই চা দোকানের সামনে এসে হাজির হন বিকল্প বেকারির ডেলিভারিম্যান রাশেদ। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, বেকারির থেকে আনা খাদ্যসামগ্রীর মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ নেই কেন? তিনি বলেন, ‘এটা তো আর আমি বানাই না। কাস্টমার বা দোকানিরা এখনো এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ করেনি, তাই এ ব্যাপারে কখনো কোনো গুরুত্ব দেইনি।’

এ ব্যাপারে মুঠোফোনে বিকল্প বেকারিতে যোগাযোগ করা হলে ম্যানেজার মজিবুর রহমান বলেন, আমরা ছোটখাটো ব্যবসায়ী, বনরুটি, বাটারবন, পাউরুটি, কেক ও বিস্কুটসামগ্রী নিত্যপণ্য হওয়ায় তার উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ প্রয়োজন হয় না। এক প্রশ্নের জবাবে মজিবুর রহমান বলেন, আপনারাতো আর ফুটপাথের দোকান থেকে এসব বনরুটি, পাউরুটি বা বাটারবন কিনে খান না। আপনারা নামী-দামি বেকারিতে খাবেন। ফুটপাথের দোকান থেকে এসব মেয়াদহীন বেকারি সামগ্রী কিনে খাবেন কেন? ছোটখাটো চায়ের দোকানে আসা সীমিত আয়ের লোকজনদের জন্যই তৈরি করা এসব বনরুটি পাউরুটি। ছোটখাটো ফুটপাথের চায়ের দোকানে আমরা নিয়মিত ডেলিভারি দিয়ে আসছি।

র‌্যাব-১০ এর একটি দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত শনিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত পুরান ঢাকার লালবাগের শহীদনগরের কয়েকটি বিস্কুট তৈরির কারখানায় অভিযান চালায়। জানা গেছে, নোংরা এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ভেজাল খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করার অপরাধে আয়েশা-আছমা ফুড প্রডাক্টসের মালিক জাহাঙ্গীর আলমকে তিন লাখ টাকা ও কাজল বিস্কুট ফ্যাক্টরির মালিক মঞ্জিল মিয়াকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তারা ভষিষ্যতে ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করবে না মর্মে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।

টি এইচ বেকারি ও হযরত গোলাপ শাহ্ বেকারি এন্ড ব্রেড এর মালিক পক্ষরা জানান, বিভিন্ন উচ্চ মহলের যোগ মাধ্যমে চলে তাদের বেকারি পরিচালিত হয় । টি এইচ বেকারি মালিক ওমর ফারুক নিজেকে সাংবাদিক ও প্রভাবশালী বলে নিজেকে দাবি করে বলেন, মেনেজ করে চলছে তার বেকারি পুনরায় একই ভাবে হযরত গোলাপ শাহ্ বেকারি এন্ড ব্রেড মালিক পক্ষরা অত্তান্ত সাহসিকতার সাথে নিজেদের প্রভাব দেখিয়ে বেকারিটি পরিচালনা করা হচ্ছে। এবং দুই বেকারিতে ১২ থেকে ১৬ বছরের শিশুদের দিয়ে অশাস্তকর পরিবেশে তৈরি হচ্ছে বেকারির খাবার।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার ইফফাত আরা সামসাদের কাছে এসব খাবার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি খাবার খাওয়া উচিত নয়। এসব খাবারে যেসব জিনিস মেশানো নয় তা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এসব খেলে তাৎক্ষণিকভাবে গ্যাসফরম শুরু হয়। অনেক সময় পেটের পীড়ায় অনেক দিন ভোগে। বমি হয়। ডায়েরিয়া হয়। অনেক সময় শরীর কষে গিয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়ানোর পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, এসব খাবার খেয়ে অনেক সময় মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা: কামরুল ইসলাম বলেন, এসব খাবারের জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়া থেকে মারাত্মক রোগ সৃষ্টি হতে পারে। দীর্ঘ দিন খেলে মানুষ দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থ হতেও পারে।

(এসএস/এসপি/অক্টোবর ২০, ২০২০)