রণেশ মৈত্র


করোনা সৃষ্ট বিভীষিকা তার ভয়ংকর চেহারা নিয়ে তার আগমনীর অষ্টম মাস পার করছে? বাংলাদেশে করোনা মহামারীতে সংখ্যার দিক থেকে বহুদেশের চেয়ে কম হলেও বাংলাদেশ যাঁদেরকে ইতোমধ্যেই হারালো তাঁদের নামের তালিকা দেখলে একাত্তরের মতই আঁতকে উঠি। মনে পড়ে যায় ১৪ ডিসেম্বরের কথা-যে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭২ থেকেই আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে প্রতি বছর পালন করে আসছি। 

একাত্তরেও মার্চ থেকে ঐ বর্বর হত্যালীলার সুরু হয়েছিল-চলেছিল ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্য্যন্ত। এবারে, এই ২০২০সালেও, নির্মমতার সাক্ষাত মেলে মার্চ থেকে। ডিসেম্বর এখনও আসে নি। কিন্তু এই আট মাস সময়কালের মধ্যে যাঁদেরকে আমরা হারিয়েছি-তাঁদের তালিকার দিকে চোখ মেললে আঁতকে না উঠে পারা যায় না। ঐ দিন যে কয়জন শীর্ষ বুদ্ধিজীবীর তালিকা সংবাদপত্রগুলি প্রতি বছর আজও তাদের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশ করে আসছে-এই অক্টোবর, ২০২০ পর্য্যন্ত করোনার নির্মমতায় হারানো শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তার চাইতে অনেক বড়।

একাত্তরে বাড়ী থেকে বুদ্ধিজীবীদেরকে মুখোশ পরে রাতের অন্ধকারে ধরে অন্যত্র নিয়ে হত্যা করা হয়েছিল-এবারও করোনা মুখোস (মাস্ক) পড়েই আসে-যাকে হত্যা করবে তিনিও মাস্ক পরে বাড়ীতে হাসপাতালে বা আইসোলেশনে মাস্ক বা মুকোশ পরে থাকা সত্বেও ঠিকই চিনে নিচ্ছে তাঁদেরকে। একাত্তরের মতই তারা স্বজনদের থেকে ছোঁয়াচে চরিত্রের রোগের কারণে স্বজনদের থেকে বিছিন্ন অবস্থায়ই তাঁদের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে।

আবার লোকান্তরিত ঐ বিদগ্ধজনদেরকে একাত্তরে যেমন ভয়ে যেমন তাদের শেষকৃত্য করতে পারে নি-এই ২০২০ এ এসে ঠিক তেমনই স্বজন শুভাকাংখীরা পারছেন না তাঁদের শেষকৃত্যাদিতে শরীক হতে ঘটনা জানা সত্বেও। এটি, আমার মনে হয়, একাত্তরের চেয়েও ভয়াবহ কারণ সেদিনকার বুদ্ধিজীবীরা ঘরে বসে হলেও ঐ অবরুদ্ধ বাংলাদেশে থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে লেখালেখি করেছিলেন বা ক্ষেত্র বিশেষে নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সহযোগিতা করছিলেন কিন্তু এবারে তো তা না। এবারে তো ঐ অর্থে বাংলাদেশ অবরুদ্ধ না কেউ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধও করছে না-তাই সে কার্জে কাউকে সহায়তাও করছিলেন না। তবু ঘটলো-ঘটছে-ঘটেই চলেছে নির্বিচারে।

১৯৭১ এ হত্যালীলার সমাপ্তি ঘটেছিল ডিসেম্বরে-এবার তার প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে যে হত্যালীলা শুরু হয়েছে তা যে ডিসেম্বরে সমাপ্ত হবে তার কোন সম্ভাবনাই দৃশ্যমান হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরাও তা বলছেন না বরং বলছেন, শীতে করোনার দ্বিতীয় তরুঙ্গ আরও অনেক ভয়াবহতা নিয়ে হাজির হওয়ার আশংকা। ইউরোপে শীত চলছে সেখানে নতুন করে সৃষ্ট ভয়াবহতা বিশেষজ্ঞদের ঐ আশংকাকেই সত্য বলে প্রমাণ। করছে। দ্বিতীয় ঢেউ আরও অনেক দেশকে ইতোমধ্যেই আঘাত করেছে।

এবারে পেছন ফিরে তালিকাটা দেখি, বাঙালি জাতির আলোর দিশারী যাঁদেরকে ইতোমধ্যেই হারিয়েছি তাঁদের তালিকাটা-তাঁদের নামগুলি।

১। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, যিনি তাঁর প্রজ্ঞা, তাঁর লেখনী, তাঁর দেশপ্রেম, তাঁর সাহস দিয়ে বাঙালি জাতিকে সারা জীবন উজ্জীবিত অনুপ্রাণিত করেছেন মুক্তিযুদ্ধে বিপুল ভূমিকা রেখেছেন, ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, সাহসের মৌলবাদের বিরোধিতা করেছেন, স্বয়ং আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে কুখ্যাত এক যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে সাহসের সাথে সাক্ষ্য দিয়ে তার মৃত্যুদ- নিশ্চিত করেছেন এবং ফলে নিজেও তাদের টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন সেই অসাধারণ গুণসম্পন্ন হাজার হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকার শিক্ষক-জাতীয় অধ্যাপককে গ্রাস করলো করোনা।

২। জিয়াউদ্দিন তারিক আলী। প্রচার বিমুখ বহুমুখী প্রতিভা সম্পন্ন এই মুক্তিযোদ্ধাকে গত ৭ সেপ্টেম্বর কেড়ে নিলো করোনা তাঁর প্রিয় স্বদেশ ও স্বজনদের কাছ থেকে। ১৯৬৬ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী আটজনের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম রাজধানী ঢাকার শেরে বাংলা নগরে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নতুন বিশাল ভবন নির্মানের বহুমুখী কাজের তিনি ছিলেন প্রধান সমন্বয়ক। এর অবকাঠামো ও কর্মধারার সকল স্তরের জড়িয়ে আছে তাঁর হাতের ছোঁয়া।
১৯৭০ সালে জিয়াউদ্দিন তারিক আলী গণসঙ্গীতের দলে অন্তর্ভূক্ত হয়ে রাজপথে গান গেয়ে বেড়িয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তিনি সীমান্ত পাড়ি দেন এবং মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী দলের সদস্য হয়ে তিনি শরণার্থী শিবির, মুক্তিযোদ্ধাদের শিবির, মুক্ত এলাকাগুলিতে গানের মাধ্যমে উদ্দীপ্ত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি।

এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতি। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন ঐ আন্দোলনের প্রধান উপদেষ্ট-প্রধান পৃষ্ঠপোষক।

করোনায় এবং করোনাকালীন সময়ে আরও যাঁদেরকে জাতির যে শ্রেণী সন্তানদেরকে বাঙালি জাতি হারিয়েছে তাঁদের তালিকায় স্থান পেয়েছে। জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী-যিনি যমুনা বহুমুখী সেতু এবং নির্মীয়মান পদ্মাসেতু প্রকল্পের উপদেষ্টার ভূমিকায় থেকে প্রকৌশলী হিসেবে অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন; মহান মুক্তিযুদ্ধের দুই নায়ক সেক্টর কম্যা-ার সি.আর দত্ত ও সেক্টর কম্যা-ার আবু ওসমান চৌধুরী, এটর্নী জেনারেল মাহবুব আলম, রাজনীতিক মোহাম্মদ নাসিম নারীনেত্রী রাখি দাস পুরকায়স্থ, গীতিকার আলাউদ্দিন আলী, বিজ্ঞানী অধ্যাপক আলী আসগর, শিল্পী-ভাষা সৈনিক মুর্তজা বশির, কন্ঠশিল্পী এ-্রু কিশোর, স্থপতি মৃণাল হক, অধ্যাপক রিয়াজুল ইসলাম এবং এই তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হলেন খ্যাতনামা কথা সাহিত্যিক রশীদ হায়দার এবং বিশিষ্ট কবি ও গবেষক অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন জাহেদী।

এযাবত এই ১৭ জনের নাম জানতে পেরেছি। আরও হয়তো কেউ কেউ আছেন যাঁদের নাম স্মরণে আনতে পারছি না।
এছাড়া যাঁর নাম উল্লেখ না করলেই নয়-তিনি হলেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু প্রণব মুখার্জী। তালিকাটি যতই দিন যেতে থাকবে-ততই আরও দীর্ঘ হতে থাকবে এবং এর শেষ কোথায় তা কেউই জানি না।
বাঙালিী জাতি করোনায় এবং করোনাকবলে এই যে তাঁদের শ্রেণ্ঠ সন্তানদের হারালেন, জাতির দুর্ভাগ্য, বাঙালি সংস্কৃতি অনুযায়ী তাঁদের জানাযা, শ্রাদ্ধ প্রভৃতিতে ঐতিহ্য অনুসারে হাজারে হাজারে আমরা সমবেত হতে পারি নি। পারা যায় নি তাঁদের শ্রাদ্ধের আয়োজন করতে-সম্ভব হয় নি তাঁদের জন্যে কোন স্মরণ সমাবেশ আয়োজন করতে।

তবে কি এক বা দুই বছর পরে ইতোমধ্যে আরও যাঁদেরকে হারাবো সেইসব প্রিয়জনদের গণহারে স্মরণ সভা করবো-যদি তার মধ্যে করোনার ভাইরাস থেকে আমরা সকলে মুক্তি পেতে পারি।

আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, আজ পর্য্যন্ত পৃথিবীর অন্য কোন দেশে করোনায় ও করোনাকালে এত বেশী সংখ্যক বিমিষ্ট জনদেরকে এখন পর্য্যন্ত হারান নি।

এখন অত:পর কি করা? আমরা কি কোন অলৌকিক ক্ষমতার ভরসায় থাকবো? ঐ অদৃশ্য কোন ক্ষমতা এসে করোনা প্রতিরোধ করবে-মানুষ বাঁচাবে? এমন কোন ধারনা যদি আমরা একজনও মনের কোণে পোষণ করি তবে মারাত্মক ভুল করবো।

আজ বাঙালি সংস্কৃতির যে বিপর্য্যয় করোনা সৃষ্টি করেছে-সেই বিপর্য্যয়ের হাত থেকে আমরা আমাদেরকে, আমাদের সকলকে না সম্ভব হলেও বেশীর ভাগ লোককে বাঁচানো সম্ভব হয়। এ কাজটি করতে পারে একমাত্র বিজ্ঞান। বিজ্ঞান যেদিন নির্ভরযোগ্য প্রতিরোধ এবং প্রতিষেক আবিষ্কার করবে এবং তা সহজলভ্য হবে তখনই একমাত্র আমরা রেহাই পাব।

বৈজ্ঞানিকেরা সে গবেষণা চালাচ্ছেন বহু দেশে। কোন কোন দেশ দাবী করছে তারা চূড়ান্তভাবে মানবদেহে প্রয়োগে সফল হলেই ব্যাপক পরিমাণে উৎপাদন করে দেশ-বিদেশের বাজারে পৌঁছাবেন। কিন্তু জানা যাচ্ছে না ঠিক কত দিনে ঐ প্রতিরোধক-প্রতিষেধক ঠিক ঠিক কখন মানুষের দুয়ারে পৌঁছাবে। কেউ কেউ নিশ্চিত করতে চাইছেন-আগামী ২০২১ সালের প্রথম দিকে তা সম্ভব হবে কিন্তু নিশ্চিত করে তা বলা যাচ্ছে না।

তা হলে যতক্ষণ পর্য্যন্ত বৈজ্ঞানিক আবস্কিার চূড়ান্ত না হয়, যতক্ষণ পর্য্যন্ত না ঐ আবিষ্কার পৃথিবীর সকল দেশের মানুষের ঘরে না পৌছায়-ততক্ষণ তো বসে থাকা যাবে না। বাঁচার জন্য লড়াই চালিয়ে যেতেই হবে। আর সে দায়িত্ব ব্যক্তির, পরিবারের, সমাজের এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের। এই চার অংশের একটি অংশও যদি নিষ্ক্রিয়, সিস্পৃহ থাকেন তবে মানুষের বাঁচার নিশ্চয়তা খুবই কম-যদি জোরদারভাবে শীতকালীন দ্বিতীয় ধাক্কা আশংকা অনুযায়ী সত্যিই বাড়ে।
প্রথমত; ব্যক্তিগতভাবে সকলেই মাস্ক পরিধান মানুষে মানুষেদুই গজ দূরত্ব রক্ষা করে চলা, কোথাও ভীড় তৈরী না করা-করলে তা সযতনে এড়িয়ে চলা, ব্যবসায়ীদেরকে পাড়া-মহল্লায় রিকসা ভ্যানে শাক-সবজী তরী-তরকারী মাছ তেল ডাল প্রবৃতি রোজ সকলে বিক্রীতে উৎসাহিত করা এবং যতটা সম্ভব পুষ্টিকর খাবার খাওয়া।
সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে এগুলি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে।

রাষ্ট্রের দায়িত্ব সর্বাধিক। যত কথাই বলা হোক, এ যাবত এ ব্যাপারে রাষ্ট্র তার দায়ীত্ব যথাযথভাবে পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তাই ঐ ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তা দূর করতে যথেষ্ট সময় হাতে রেখে করোনা প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

আমার বিবেচনায় ব্যবস্থাগুলি হওয়া উচিত নিম্নরুপ :

এক. উপজেলা পর্য্যায় পর্য্যন্ত প্রতিদিন ন্যূনতম নির্দিষ্ট সংখ্যক (প্রতি উপজেলায় এ সংখ্যা প্রতিদিন ২০০ হতে পারে) মানুষের করোনা টেষ্ট করার কিট্স্ সরবরাহ করা;

দুই. প্রতি জেলায় পিসিআর ল্যাব অবিলম্বে স্থাপন করা;

তিন. প্রতি জেলার সরকারি হাসপাতলে করোনা ওয়ার্ড স্থাপন করে অন্তত: ২৫ বেড, উপযুক্ত সংখ্যায় চিকিৎসক, নার্স ও অপরাপর স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের ব্যবস্থা;

চার.প্রতিটি সরকারি জেলা হাসপাতালে প্রয়োজনীয় পরিমাণ অক্সিজেন ও অন্তত: আটটি করে আই.সি.ইউ স্থাপন করা;

পাঁচ. করোনা পরীক্ষার জন্য যাবতীয় ফি প্রত্যাহার করে নেওয়া;

ছয়. বাড়ীর বাইরে মাস্ক ছাড়া বের হলে জনপ্রতি কম পক্ষে ১,০০০ টাকা করে জরিমানা আদায় করার জন্য সর্বত্র ভ্রাম্যমান আদালত স্থাপন করা;

সাত. জেলা-উপজেলা পর্য্যায়ে মাস্ক পরিমাণ ও সমাবেশ জটলা বন্ধে টহল পুলিশের ব্যবস্থা করা;

শেষে যে কথাটি বলতে একাত্তরে আমরা জানতাম বাঙালির শত্রু কারা এবং সেই শত্রুরা-যেমন পাক-বাহিনীর সদস্যরা, রাজাকার-আলবদরেরা এবং শান্তি কমিটিার লোকেরা ছিল দৃশ্যমান। তাই তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং বিজয়ী হতে পেরেছিলাম মাত্র নয় মাসের মধ্যে।

কিন্তু এবারের শত্রু একটি ভাইরাস-যা দৃশ্যমান নয়। তাই তাকে পরাস্ত করতে সময় লাগা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
তাই কামনা করবো, বিজ্ঞানীরা সত্বর সফল হবেন এবং মানুষ বাঁচাতে সর্বত্র মানুষের কাছে প্রতিরোধক প্রতিশেষক সহজলভ্যভাবে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।

নিজে বাঁচতে হবে, পরিবারকে বাঁচাতে হবে, বন্ধু-বান্ধবসহ গোটা সমাজ ও দেশকেও বাঁচাতে হবে।

লেখক : সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।