আবীর আহাদ


বেশকিছু দিন যাবত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের মধ্য থেকে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমাণ্ড কাউন্সিলের নির্বাচনের জোরালো দাবি উঠেছে এবং দাবিটি সংগতকারণে দিনকে দিন প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই । কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মহোদয় কেনো ও কী কারণে সেই নির্বাচন স্থগিত করে রেখেছেন তা অনেকের কাছেই বোধগম্য ছিলো না । তবে সচেতন মুক্তিযোদ্ধারা হয়তো এর পেছনের কারসাজিটা বুঝতে পারেন । মূলত: মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্রের জুয়া ও অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানানোর বিশাল বাণিজ্যকে কেন্দ্র করেই মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে । ক্যাসিনো বন্ধ অভিযানের ফলে মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্রের জুয়াও বন্ধ হয়ে গেছে । অপরদিকে বিশাল ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বাণিজ্য প্রকল্পের কাজও গুটিয়ে এসেছে ।

ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের উদরপূর্তিও ঘটেছে। ফলে এখন মুক্তিযোদ্ধা+অমুক্তিযোদ্ধা = মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রকাশ ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন দেয়াই যায় । এই নিরিখে সম্প্রতি মুবিম মন্ত্রী বাহাদুর আগামী ষোলো ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের তথাকথিত তালিকা প্রকাশসহ আগামী জানুয়ারি মাসে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন করার একটা ইংগিত দিয়েছেন । যদিও মুক্তিযোদ্ধারা মিথ্যাচার ও অতিকথনপ্রিয় মন্ত্রীর কোনো কথার ওপর আস্থা রাখেন না, তারপরও কেনো জানি এবার সবাই একটু নড়েচড়ে বসেছে । কিন্তু সবচে' বড়ো প্রশ্ন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচনে ভোটার কারা ?

আমরা জানি, যেখানে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দেড়লক্ষের নিচে, সেখানে সরকারি গেজেটে আসছে দু'লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার মুক্তিযোদ্ধা । সেই হিসেবে কমবেশি পঁচাশি হাজারই অমুক্তিযোদ্ধা । এর মধ্য যারা জীবিত আছেন তারাই হবেন নির্বাচনের ভোটার । আমাদের পরিসংখ্যান বলে, এসব ভোটারের মধ্যে হয়তো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে অমুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বেশিই হবে । ফলে অমুক্তিযোদ্ধারাই সেই নির্বাচনে বিপুল ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে । বিশেষ করে উপজেলা/জেলা পর্যায়ের নির্বাচনে অমুক্তিযোদ্ধারাই বেশি প্রার্থী হবে এবং তাদের পক্ষে অমুক্তিযোদ্ধারাই ভোট দেবে । সেই প্রভাবে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে যে প্যানেল ভুয়াদের ব্যাপারে নমনীয়, সেই প্যানেলই নির্বাচনে জিতবে । ফলে নির্বাচনে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সবস্তরই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে যাবে ।

এ-কথাও সত্য যে, মুক্তিযোদ্ধাদের দাবিদাওয়া পূরণের লক্ষ্যে একটি নির্বাচিত শক্তিশালী বডি থাকা বাঞ্ছনীয় । কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সিংহভাগ সদস্য বয়সের ভারে ও রোগেশোকে নূয়ে পড়েছেন এবং তারা মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে ধুকে ধুকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন । একটি সংঘবদ্ধ উপায়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা তাই অপরিসীম । এক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা সংসদে একটি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বাচিত কমিটি তাদের দু:খ-দুর্দশা দূর করার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে । এ ব্যতীত, আজ দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী যে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উত্থান ঘটেছে, সেটাকে প্লতিহত করতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বিপুল ভূমিকা পালন করতে পারে । দেশে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের বহুসংখ্যক সংগঠন গড়ে ওঠার ফলে মুক্তিযোদ্ধা ও প্রজন্মরাও বিভক্ত হয়ে পড়েছে । এবং এসব সংগঠনগুলোর মধ্যে আন্ত:সংগঠন বিরোধ থাকায় জাতীয় প্রয়োজনে তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারছে না ।

আরেকটি প্রবণতা বিদ্যমান যে, সবাই নেতা হতে চান । কেউ কাউকে মান্য করতে চান না । অনেকে আবার কোনো প্রকার যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক, অর্থ ও রাজনৈতিক শক্তিতে বলিয়ান হয়ে নেতা হতে চান । কেউ কেউ নেতা হতে না পেরে সংগঠনের ভেতর নানান চক্রান্ত ও কোন্দল সৃষ্টি করে সংগঠনের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে থাকেন । অনেক ক্ষেত্রে নেতা হতে যাওয়ার লক্ষ্যে নিজ সংগঠনসহ ভিন্ন সংগঠনের মধ্যে হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, অপবাদ, কুৎসাসহ নানান চক্রান্তের ফলে কোনো জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা নেতৃত্ব সৃষ্টি হতে পারছে না ।

এ ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ব্যতিক্রম । দেশে বহুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন থাকলেও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ যে একটি একক জাতীয় সংগঠন সে-সম্পর্কে কারো দ্বিমত নেই । আর সরকারও মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে মুক্তিযোদ্ধাদের একক প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন গণ্য করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকে । অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বিস্তৃতি দেশের ইউনিয়ন পর্যন্ত থাকায় এ সংগঠনের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক বিপ্লবসহ জাতীয় যেকোনো অনিয়ম-অসংগতির বিরুদ্ধে বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব----- সে-বিষয়ে সন্দেহের কোনোই অবকাশ নেই । ফলে জাতীয় ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বিষয়ে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা গড়ে উঠেছে ।

তবে কথা থেকে যায় । মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচনের ভোটার হলো মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাগণ । আর ঐ তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাগণের মধ্যে কমবেশি পঁচাশি হাজার অ-মুক্তিযোদ্ধাই শুধু নয়-----তাদের মধ্যে বেশ কয়েক হাজার রাজাকারও রয়েছে বলে আমরা সকলেই জানি ! এ বিষয়ে আগেই কিছুটা আলোচনা করা হয়েছে । মূলত: বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকার বঙ্গবন্ধু সরকারের বাহাত্তর সনের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা বাতিল করে নানান গোঁজামিলের সংজ্ঞা ও ভুয়া নির্দেশিকায় ঐসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় স্থান করে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে ।

অতীতে বিভিন্ন সরকারের অ-সদিচ্ছাই শুধু নয়, তথাকথিত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল ( জামুকা) এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তথাকথিত নির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমাণ্ড কাউন্সিলসহ জেলা মহানগর উপজেলা ও ইউনিয়ন কমাণ্ডাররা ব্যক্তিস্বার্থে ঐসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টিতে বিশাল ভূমিকা রেখেছেন । তাদের অর্থলিপ্সার কারণে লাল মুক্তিবার্তা, গেজেট ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তালিকায় ঐ পরিমাণ ভুয়ারা আজ সগর্বে মুক্তিযোদ্ধা সেজে রাষ্ট্রীয় ভাতাসহ নানান সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছে । এসব দেখে দেশের জনগণ ও বিভিন্ন মহলে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয়েছে । এ-প্রক্রিয়ায় সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের মান-মর্যাদা বলতে কিছু নেই । অপরদিকে রাজনৈতিক, দলীয় ও আত্মীয়তার কারণে বিভিন্ন সরকার মুক্তিযোদ্ধা তালিকার ব্যাপারে অন্ধের মতো চোখ বন্ধ করে আসছে । ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিতাড়নের বিষয়ে যেনো কারো কোনো দায়িত্বই নেই ! মূলত : জাতীয় সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি না-থাকার ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে রাষ্ট্র তথা সরকারের এহেন দায়িত্ববোধের অভাব সৃষ্টি হয়েছে ।

এসব কারণ অনুধাবন করে আমার নেতৃত্বে গত ২০১৮ সালের গোড়ার দিকে "একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ"-এর ব্যানারে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৭ সনের বাণিজ্যনির্ভর মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই বাতিলসহ 'মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা'র দাবিতে একটি আন্দোলন গড়ে তুলি । সেই আন্দোলনের প্রেক্ষিত তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই স্থগিত হয়ে যায় । আমার যতোদূর মন হয়, আমাদের মূল দাবির যৌক্তিতা অনুধাবন করে পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহারে মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় তথা সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান ও মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা পুন:প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার লিপিবদ্ধ করেছিলেন ।

আমাদের সকলের এখন একটাই কাজ হওয়া উচিত, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পতাকাতলে জড়ো হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে 'মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় তথা সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান' ও মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অপসারণের মাধ্যমে 'মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা পুন:প্রতিষ্ঠা'র যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তা বাস্তবায়নে একটি সংঘবদ্ধ প্রয়াস গড়ে তোলা । রাষ্ট্রীয়ভাবে মর্যাদাহীন ও ভুয়ার ভারে অপমানিত থাকার কোনো অর্থ থাকতে পারে না । আমরা চাই, সর্বাগ্রে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সঠিক ও সর্বজনগ্রহণযোগ্য তালিকা প্রণয়ন করা হোক । তারপর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন ।

এমনি অবস্থায়, বিদ্যমান মুক্তিযোদ্ধা তালিকার ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন মানে 'যে যবর যা, যে-জাতের তা'-----যা-তা ! এ-প্রেক্ষিতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচন মানে-----বিশালসংখ্যক ভুয়া ভোটারের আইনি সুরক্ষায় আইনগত: স্থায়ী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়ে যাবে । এমতাবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন মানে-----অতীতের ভুয়ার কারিগররা বিশাল ভুয়াদের সমর্থনে নির্বাচনে আবার বিপুলভাবে বিজয়ী হয়ে আসবে । কারিগররা পুনরায় নতুন ভুয়া সৃষ্টির লাইসেন্স পেয়ে যাবে, আর অর্থের বিনিময়ে পুরাতন ও নতুন ভুয়াদের সুরক্ষা দিয়েই যাবে ! এ-অবস্থা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না ।

অতএব, মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা না-হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কোনো নির্বাচন হতে পারে না । তাই দ্রুতগতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকা প্রণয়ন করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি । একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সীমাহীন শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার যে নিরলস সংগ্রাম করে চলেছে, সেই প্রয়াসের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন দেয়া তাই সকল প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধার নৈতিক কর্তব্য । মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নের পর জাতীয় মর্যাদায় যে-কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধা যতো পারেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন করতে থাকবেন, তাতে কেউ কাউকে বাধা দেবে না । কারো কিছু বলারও থাকবে না ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।