আবীর আহাদ


মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে দুর্নীতি ও লুটপাটনির্ভর উন্নয়ন কোনো সুষ্ঠু মস্তিষ্কসম্পন্ন মানুষের কাম্য নয় । পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, রিভার টানেল, বিরাট বিরাট রাস্তাসহ এ-ধরনের আরো বড়ো বড়ো উন্নয়নমূলক প্রকল্পের বাস্তবায়ন আমরা চাই । এসব উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করার সেই অর্থশক্তি আজ বাংলাদেশ অর্জন করেছে । আমাদের কৃষক, আমাদের শ্রমিক এবং আমাদের বিদেশে কর্মরত মানুষের কষ্টার্জিত আয়ের অর্থে আমাদের এই অর্থশক্তি গড়ে উঠেছে । তাই উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ঐসব মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ লুটপাটের অবকাশ থাকার কথা নয় । কিন্তু দু:খজনক সত্য যে, আমরা এসব বড়ো বড়ো প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে সাগর লুট দেখছি !

আমরা জানি এবং এটাই নিয়ম যে, একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তার ব্যয়ভার নির্ণয় তথা ভূমি ক্রয়, কাঁচামাল আমদানি, শ্রমিক-কর্মচারীর বেতন, বিদ্যুত খরচ, প্রকল্পের সময়সূচির বাজার মূল্য স্টাডিকরণসহ আনুষঙ্গিক বিষয়াদি মূল্যায়ন করে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের লাভের অংক ধরেই প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়ে থাকে ।

সে-নিরিখে বিশ হাজার কোটি টাকার পদ্মাসেতু নির্মাণের প্রাথমিক ও মধ্যম স্তরেই তার দ্বিগুণ অর্থ ইতোমধ্যে খরচ হয়ে গেছে । প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হতে আরো কতোগুণ খরচ বৃদ্ধি করা হবে কে জানে ! এমনিভাবে চারশত কোটি টাকার ফ্লাইওভার যখন পনেরো শত কোটিতে ঠেকানো হয়, কতো হাজার কোটি টাকার মেট্রোরেলের ব্যয়ভার কতোগুণ বৃদ্ধি হবে, কতো হাজার কোটি টাকার রিভার টানেল ও রাস্তা নির্মাণের ব্যয়ভার কতোগুণ বৃদ্ধি করা হবে কে জানে ! এছাড়া বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প বা প্রতিষ্ঠানের মালামাল ক্রয়ের ক্ষেত্রে কী সাগরচুরি দেখছি----যেমন, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে চারশত টাকার একটি বালিশের দাম হয়ে যায় সাত হাজার টাকা, মেডিকেলের আট হাজার টাকার একটি বইয়ের দাম হয়ে যায় পঁচাশি হাজার টাকা, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কয়েক হাজার টাকার পর্দার মূল্য হয়ে যায় সাঁইত্রিশ লক্ষ টাকা, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের দু'টি কম্পিউটার রক্ষণাবক্ষেণের খরচ দেখানো হয় সাতাশ লক্ষ টাকা ! এমনতর সাগরচুরি সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সংঘটিত হচ্ছে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই । এর মূলে রয়েছে সরকার পরিচালনার সাথে জড়িত মন্ত্রী এমপি আমলা, প্রকৌশলী, ঠিকাদারসহ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের লোকেরা ।

এসব বিষয়গুলো প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত হলেও, দুর্নীতিবাজ লুটেরাদের ব্যাপারেও সরকার বলা চলে নিশ্চুপ থাকে । মাঝে মাঝে লোকদেখানো দুর্বল কিছু দুর্নীতিবাজকে দুদকের কার্যালয়ে ডেকে নেয়া হয় । তবে ফলাফল অজ্ঞাতই থেকে যায় । আসলে রাঘব-বোয়াল দুর্নীতিবাজ লুটেরাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় সরকারের উচ্চ মহল । তাদের নিকট থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন নিয়ে এদেরকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দিয়ে থাকে বলেই এরা অধরাই থেকে যায় ।

এক খবরে দেখতে পাওয়া গেলো, বিগত একদশকে বাংলাদেশ থেকে বিদেশ পাচার হয়েছে আট/নয় লক্ষ কোটি টাকা । এসবই ঐসব প্রকল্পসহ ভুয়া প্রকল্পের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নেয়া অর্থ । বেশকিছু কাল আগে সুইস ব্যাংক ও পানামা পেপার্সে বাংলাদেশের কতিপয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের খবর প্রচারিত হয়েছিল । এসব পাচারকৃত অর্থে আমেরিকা, লণ্ডন, কানাডা, মালায়েশিয়া প্রভৃতি দেশে বিশাল অর্থ পাচারসহ সেসব দেশে অনেকেই সেকেণ্ড হোম গড়ে তুলেছে । এসব দুর্নীতিবাজ লুটেরা গোষ্ঠী তাদের ভবিষ্যত বংশধরদের নিরাপদ জীবনের জন্য তাদেরকে ঐসব দেশে লেখাপড়া করাচ্ছে । অর্থাত্ এদেশের প্রতি তারা দায়বদ্ধ নয় । এদেশ থেকে নানান ছলেকলেকৌশলে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়ে বিদেশের মাটিতে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে ।

আমি বাংলাদেশের একটি বহুমুখী বিশাল বাণিজ্যক প্রতিষ্ঠানের একটি খবর জানি । বিগত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনের তিন/চার মাস পূর্ব থেকেই সেই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার তাদের প্রধান কার্যালয় সিঙ্গাপুর ও মালায়েশিয়ায় স্থানান্তর করে পরিবার-পরিজনসহ সেখানে চলে যান । নির্বাচনের পর তার মনঃপূত সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেই তিনি আবার প্রধান কার্যালয়সহ পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশে ফিরে আসেন । এভাবেই চলে আসছে দেশের চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ লুটেরা রাজনীতিক আমলা ও ব্যবসায়ীদের কায়কারবার ।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অঙ্গীকার ও দেশপ্রেমের প্রতি যারা দায়বদ্ধ নয় তাদের কাছে দুর্নীতি ও লুটপাটসহ নানান সমাজ ও দেশবিরোধী কার্যকলাপ হলো ভাত-মাছ । নিজেদের এবং তাদের গোষ্ঠীস্বার্থে তারা যেকোনো অন্যায় ও অপরাধ করতে তাদের বিবেকে বাঁধে না । দেশটা যে মুক্তিযুদ্ধের রক্তের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য ত্যাগ ও বীরত্বে অর্জিত হয়েছে, এটা তাদের মনেই নেই । মনে থাকার কথা নয় । আজ যারা সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সেসব রাজনীতিক, মন্ত্রী, এমপি, আমলা, ব্যবসায়ী----এদের অধিকাংশের সাথে মুক্তিযুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই । যারা মুক্তিযুদ্ধের রক্ত ও কষ্ট দেখেছে, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করছে তারা দুর্নীতি ও লুটপাট করতে পারে না ।

আজকে দেশের মধ্যে যেসব মহাদুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের আমরা দেখতে পাচ্ছি, তারা কেউ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নয় । এমনকি সরকারের দুর্বল ও গোঁজামিল মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞায় অর্থ আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় যেসব অমুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা বনে যাচ্ছে তারাও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে নয়; তারা টাউট-বাটপাঢ় । যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, দু:খের সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি, দেশের সিংহভাগ দুর্নীতিবাজ লুটেরা স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এখন তার পকেটে ঢুকে গেছে ! বিএনপি-জামায়াত ও জাতীয় পার্টি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারের মধ্যে নেই, ফলে তাদের প্রতি আমাদের কোন অনুযোগ নেই । আছে শুধু ধিক্কার । আমাদের আদর্শ, আমাদের চেতনা, আমাদের আশা-আকাঙ্খা, আমাদের মান-অভিমান-অনুযোগ সবকিছুই আওয়ামী লীগকে ঘিরে । কিন্তু বড়োই পরিতাপের বিষয়, আজ আওয়ামী লীগও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে যোজন মাইল দূরে অবস্থান করছে ।

মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী আওয়ামী লীগের দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকার দাবিতে গোটা মুক্তিযোদ্ধা সমাজ চেয়ে আছে । কিন্তু তাদের কোনোই প্রতিক্রিয়া নেই । মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থসামাজিক উন্নতজীবনের আকাঙ্খা আজ মানবেতর জীবনে পর্যবসিত হয়ে গেছে । অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধার মাথা গোঁজার ঠাই নেই । সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে তাদের কোনো মর্যাদা নেই । এইতো গত বছর ওমরা হজ্বে ষাটজন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী হেফাজতি মোল্লাকে নেয়া হলো, কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধাকেও নেয়া হলো না ! সরকার প্রধানের বিদেশ সফরের সময় সমাজের বিভিন্ন স্তরের দুর্নীতিবাজ লুটেরা অনেকেই জামাই আদরে সফরসঙ্গী হয়, কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধাকেও সে-সফরে নেয়া হয় না ! যে যৎকিঞ্চিত ভাতা দেয়া হয়, তাতে তাদের চিকিত্সা নিতেই তা খরচ হয়ে যায় । তার ওপর আছে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি । ইদানীং রাজাকারগোষ্ষ্ঠী তাদের ওপর একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে । বলা চলে তারা (রাজাকাররা) প্রায় সবাই এখন আওয়ামী লীগ করে । গ্রামেগঞ্জে কিংবা শহরের সর্বত্র চলছে মুক্তিযোদ্ধা উৎপাটনের হলাহল ।

এটাই হলো আজ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের অবস্থা । চারদিকে দুর্নীতি লুটপাট ও ধর্মান্ধতার হলাহলের ফলে সামাজিক মূল্যবোধে চরমতম ধস নেমেছে । মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা ও সৌজন্যবোধ হারিয়ে গেছে । সবকিছুই মূল্যায়িত হচ্ছে আর্থিক মাপকাঠিতে । সমাজের সৎ মেধাবী, ত্যাগী মানুষেরা অবমূল্যায়নের চরম শিকার হচ্ছে । দেশের প্রতি মমত্ববোধ আজ তলানিতে এসে ঠেকেছে । মনে হয় যেন, বেছে বেছে খারাপ মানুষগুলোকে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে বসিয়ে দেয়া হয়েছে । বেকারত্বের অভিশাপে বিশাল শিক্ষিত যুবসমাজ দিশেহারা । দেশের ভবিষ্যত নিয়ে কারো মাথা ব্যথা আছে বলেও মনে হয় না ।সবাই আজ বিভ্রান্ত । সবাই আজ মরীচিকার পানে অন্ধের মতো ছুটে চলেছে । আর এই সুযোগে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধ জঙ্গি অপশক্তির নিরব উত্থান ঘটছে । যেকোনো সময় তার মহাবিস্ফোরণ ঘটা অস্বাভাবিক নয় । বাংলাদেশের সংবিধানের চার মৌলনীতি ও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে সেসব উপড়ে ফেলার দু:সাহসী হুমকি দিয়ে তারা আজ তাদের মূল অভিযানের জানান দিচ্ছে ! কিন্তু আওয়ামী লীগ ও তার সরকার নীরব !

দেশের চলমান সার্বিক রাজনৈতিক আর্থসামাজিক ধর্ম ও সাংস্কৃতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারে উদ্বুদ্ধ শুভশক্তি তথা দেশপ্রেমিক সৎ ও সাহসী মানুষগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধ জঙ্গি অপশক্তিসহ দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়া অশুভশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে । এর বিকল্প পথ খোলা নেই । যেসব অশুভশক্তির প্রতিবিপ্লবী অপচেতনা ও কার্যকলাপের ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কলুষিত হয়েছে, সেই হারিয়ে যাওয়া আদর্শ ও চেতনাকে আবার টেনে আনতে হবে । সংঘটিত করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটি সর্বাত্মক গণবিপ্লব । নইলে বাঙালি জাতি, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বাংলাদেশ চিরতরে হারিয়ে যাবে ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।