নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার


দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ সামাজিক অস্থিরতা এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে যেখানে মানুষের স্বাভাবিক জীবন প্রতিনিয়ন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। একেক শ্রেণি গোষ্ঠী দ্বারা একেক রকম সামাজিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সার্বিক বিচারে সকল অসামাজিক কর্মকান্ডের খারাপ ফলাফলটা ভোগ করতে হচ্ছে সমাজের সকল স্তরের মানুষের। সকল সামাজিক অপকর্ম মাথাচাড়া দেয়ার পিছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে দুর্নীতি। আর মানুষ দিনকে দিন সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে এসব সামাজিক সমস্যা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। মানুষ নিজকে নিয়ে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, সামাজিক দায়ববদ্ধতার জায়গাটাই যেন হারিয়ে ফেলেছে। নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহারের ফলে সমাজের অর্ধেক জায়গার সমস্যাই সমাধানের পথে এগুগোচ্ছে না। এই চিন্তাটা এখনও যে কেবল অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে তা কিন্তু নয়।

সামগ্রিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি যাদের মধ্যে মূল্যবোধ জাগ্রত হয়নি তাদের মাঝে এখনও এসমস্যা বিরাজমান। মানুষের মাঝে সামাজিক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ তৈরির জন্য সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড জোড়ালো করার যে প্রযোজনীয়তা রয়েছে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র তথা সামাজিকভাবে আমরা সবাই দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছি। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের বেলায় কেবল ঘরে বসে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করছি। তাও আবার ভালোর দিকটা নেহায়াতই কম। সামাজিক ব্যধির কারনে বাল্য বিয়ের ব্যপারে কঠোর আইন করেও সরকারের পক্ষে এ মহামারি রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। কেবল মাত্র আইন করে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি। কিন্তু অপরাধের উৎস স্থল বন্ধ করার কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করছি না।

অপরাধের মুখস্থল বন্ধ করতে পারলে এসব কর্মকান্ডের বিস্তার রোধ করা সম্ভব হবে না। কিছু কিছু অপরাধ পেশা হিসেবে রুপান্তর হয়েছে মানুষের চরিত্রের কারনে। সমাজ ব্যবস্থায় অপরাধিদের সুযোগ বঞ্চিত না করে বরং উৎসাহ করছে যার বেশিরভাগই ঘটছে রাজনৈতিক কারনে। যার ফলে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিবিদদের প্রতিও মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলছে। মানুষের মৌলিক চাহিদা যখন পূরণ হবার পথে ঠিক সে সময় চতুর্দিকে শংঙ্কা এত বৃদ্ধি পাচ্ছে যে যা মানুষের ভবিষ্যৎ কে ভাবিয়ে তুলছে। আগামী প্রজন্মের মানুষের সুন্দরভাবে বসবাসের জন্য অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে সমাজব্যবস্থা। যা অতি অশনি সংকেত জাতির জন্য। প্রতিদিনই পত্রিকার পাতায় ধর্ষণ খুন ইভটিজিং ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের সামাজিক অস্থিরতার খবর ছাপা হচ্ছে। মানুষ যেন ভুলেই গেছে আমরা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। কিন্তু কেন ? কি কারনে সমাজ ব্যবস্থায় এত বিশৃংখলা ?

সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় সমাজের রন্ধে রন্ধে। বিশেষ করে কিশোর কিশোরীরা দিন দিন অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে। থামানো যাচ্ছে না অসামাজিক কার্যকলাপ। আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়ায় যুব সমাজের মাঝে ভুল ম্যাসেজ চলে যাচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন অপসংস্কৃতির প্রয়োগ আমাদের সংস্কৃতির মাঝে প্রবেশ করেছে। পারিবারিকভাবে কম বয়সী সন্তানদের নিয়ন্ত্রণ করা দিনকে দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আধুনিক বিজ্ঞানের যে আবিষ্কার বিশেষ করে স্মার্ট ফোনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে। যেনতেনভাবে ব্যবহার হচ্ছে বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত এসব উপকরণ।

বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত এসব উপকরণ মানুষকে যান্ত্রিক করে তুলছে । কিন্তু এটার সাথে তাল মেলাতে পারছে না আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। একটা শ্রেণি পারিবারিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে আর অন্য পক্ষটা যত্রতত্র হারিয়ে যাচ্ছে। পারিবারিকভাবে যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে তাদের ক্ষেত্রেও সামাজিক বন্ধনটা টেকসই হচ্ছে না সবক্ষেত্রে। শিক্ষা ব্যবস্থাটা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বেশি নজর দেয়ার ফলে মানবিক শিক্ষাটা হারিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে করোনাকালে অপরাধ যেন পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলছে। মানুষের অপরাধের ধরণও পাল্টে যাচ্ছে। সংগঠিত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ। বিভিন্ন মাঠ থেকে যেমন হারিয়ে যাচ্ছে খেলাধূলা ঠিক তেমনি হারিয়ে যাচ্ছে পারিবারিক সংস্কৃতি। বিশেষ করে ধর্মীয় সংস্কৃতিগুলোও ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে।

মানবতার কল্যাণ শব্দটি যেন নির্বাসিত। জারি, পালা, যাত্রা, মাঠের খেলা, বিভিন্ন পার্বন, নৌকা বাইচ, মঞ্চ নাটক, বিয়ের অনুষ্ঠান, বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে মানুষের অংশগ্রহণ স্বউদ্যোগে। অনুষ্ঠানের বিচারে এখন অনুষ্ঠান হয় তবে তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রংমাখানো প্রাণহীন। কয়েক যুগ আগে পাড়ায় মহল্লায় লাইব্রেরি দেখা গেলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে লাইব্রেরি গ্রামেগঞ্জে চোখে পড়ে না। বর্তমান যুব সমাজ স্মার্ট ফোনে লেখাপড়ার কথা বললেও তারা কি ফোনের মাধ্যমে বইয়ের মধ্যে আছে ? যারা আছে তারা কোন ধরণের বইয়ের মধ্যে আছে সেটা ভেবে দেখার বিষয়। তারপরও জীবন জীবনের নিয়মে চলে যাচ্ছে ঘড়ির কাটার সাথে তাল মিলিয়ে। রং বর্ণহীন নিঃসঙ্গ জীবন ব্যবস্থা আমাদের সামাজিকভাবে আলাদা করে দিচ্ছে।

সামাজিক বন্ধনের অভাবের কারনে তৈরি হচ্ছে পারিবারিক বন্ধনহীনতা। মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে কারন স্বপ্ন আছে বলেই মানুষ টিকে থাকে কিছু পাওয়ার আশায়। তবে সে স্বপ্নের ভালোবাস হয় শুধু নিজেকে নিয়ে। আবার কিছু স্বপ্ন তৈরি হচ্ছে মানুষের অকল্যাণে। পারিবারিক সেতু বন্ধনের অভাব থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ নেশার সাথে আবদ্ধ হচ্ছে। যে সময়টা আমরা নেশায় আকৃষ্ট হচ্ছি সে সময়টায় আমাদের সামান্যতম বিনোদনের ব্যবস্থা থাকলেই এই অন্ধকার জগতে পা রাখতাম না। বিনোদনের অভাবে নিজকে জড়াচ্ছি ভিন্ন ভুল পথে যার মাশুল দিতে হচ্ছে সমাজকে। একসময় প্রতিটি উপজেলায় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মনিটরিং করার জন্য প্রশাসনের লোকদের সহযোগিতা করার জন্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা সার্বিকভাবে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতো। এখন এগুলিতে গ্রুপিং লবিং আর দলীয়করনের ফলে মূল কর্মকান্ডটাই হারিয়ে যেতে বসেছে।

আজ চোখের সামনে বিচার হতে দেখেও যেন ভয়ে কেঁপে উঠছে না মানুষ। একসময়কার সামাজিক বন্ধন যেন আজ নির্বাসনে। গ্রামের মাঠগুলোতে একসময় খেলা নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া হতো কে কখন খেলবে। চলতো সময় ভাগাভাগি করে নেয়ার পালা। এখন সেই মাঠ আছে নেই শুধু খেলার মতো খেলোয়ার। মাঠের আশেপাশে দেখা যায় মোবাইল দিয়ে খেলছে কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে সময় অতিক্রম করছে। আবার কেউ কেউ জড়িয়ে যাচ্ছে জুয়ার নেশায়। খেলা এখন কেবল প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিতে চলে। সময় অতিক্রান্ত করে মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য খেলা হলেও আজ সবাই যেন ভুলে যাওয়ার পথে। প্রাতিষ্ঠানের বাইরে মাঠে মাঝে মধ্যে খেলা দেখা গেলেও তার পিছনে অনেক জায়গায় রয়েছে জুয়া বা বাজি। সম্প্রতি আইপিএল খেলা শেষ হলো মানে মনে হয়েছে বাংলাদেশ থেকে কিছু দিনের জন্য জুয়া খেলা বন্ধ হলো। খেলাধুলা অনেক জায়গায় দেখা গেলেও সে যেন প্রাণহীন।

গ্রামেগঞ্জে সামাজিক কর্মকান্ড এতটাই হ্রাস পেয়েছে যে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হয়তো ভুলেই যাবে যে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বলে কিছু ছিল। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়া এবং আধুনিক আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনে যেন আমরা আমাদের অতীত ঐতিহ্যকে ভুলে যাচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষৎত প্রজন্ম অন্ধাকারে হারিয়ে যাবে।

অর্থনৈতিকভাবে যতই সফলতা অর্জন করি না কেন যদি সামাজিক ভিত্তি মজবুত করা না যায় তবে পাওয়া যাবে না আধুনিকতার সুফল। সবচেয়ে বড় কথা হলো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডকে পুনরুজ্জিবিত করে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি এদিকে ফেরাতে হবে। আধুনিক যুগের চাহিতা মেটাতে মানুষ যে পরিমান মোবাইলে আসক্ত হয়েছে তা থেকে বের করে আনতে হলে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি করা জরুরি। একসময় মাঠে খেলাধুলা বিভিন্ন প্রকার গান বাজনা চলতো সামাজিক ভাবে। আর এসব অনুষ্ঠানে সমাজের সকল স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল বেশ সরব। সামাজিক অনুষ্ঠানে সময় ব্যয় করার কারনে বিশেষ করে কিশোর বয়সের ছেলেরা বিপদগামী হওয়ার সুযোগ পেত না। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এসব কর্মকান্ড গতিপথ হারিয়ে ফেলেছে। মানুষ হয়ে পড়েছে কর্মব্যস্ত । দেখে মনে হয় যেন প্রত্যেকে একটা টাকার মেশিন । বাবা ছেলে, ভাইয়ে ভাইয়ে, মা ছেলে, আত্মীয় স্বজন একে অপরের সাথে বিবাদে জড়াচ্ছে। একটা সময় সমাজ ব্যবস্থায় বয়ষ্কদের যে মান্যতা ছিল তা আজ চোখে পড়ে না।

সামাজিক বিরোধ নিষ্পত্তিতে মুরুব্বিদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। যার ফলে অনেক সমস্যাই সামাজিকভাবে সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় সামাজিক অনাচার মানুষের এসব গুণাগুনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে প্রতিনিয়ত। গ্রামীণ সমাজব্যবস্থায় সামাজিক ব্যবস্থার ভিতটা শক্ত থাকলেও বিগত কয়েক বছরে খুব দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তনের প্রত্যাশা থাকলেও পরিবর্তনের ধরণটা যেরকম হয়েছে সত্যিকার অর্থে সেরকম প্রত্যাশা ছিল না। সামাজিক বন্ধনের মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতির বিষয়গুলি মাথায় রেখে পরিবর্তন হলে বিষয়টা সুন্দর হতো। বিদেশি সংস্কৃতি থেকে আমরা শিক্ষা নেব তবে অবশ্যই তার ভালো দিকগুলি। কারন বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি তাদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছে। সাথে সংযুক্ত হয়েছে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। তাই সব সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ থেকে শিক্ষা নেয়া যায় তবে অনুসরণ করা যাবে না ।

বিশেষ করে আকাশ সংস্কৃতি থেকে আমরা যে শিক্ষা নিচ্ছি তা আমাদের প্রতিনিয়ত অন্ধকার পথে ধাবিত করছে। বিশেষ করে বিদেশি কয়েকটি চ্যানেল আমাদের এমন কিছু দেখাচ্ছে যেগুলি আমাদের সংস্কৃতিতে নেই। আমরা শিখছি সংস্কৃতি থেকে তবে সেটা খারাপ দিকটা। তাই সরকারের উচিত আমাদের দেশিয় সংস্কৃতি চর্চ্চায় মানুষকে উৎসাহিত করা। কারন যে সমস্যাটা সমাজের প্রতি স্তরে বিরাজ করছে সেটা সরকারের একক ইচ্ছায় বা আইন প্রয়োগ এবং এককভাবে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে সমস্যার মূল উৎপাটন করা সম্ভব না। তৃণমূল পর্যায়ে আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে ছড়িয়ে দিয়ে মানুষকে সামাজিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করতে পারলে সমাজে যে বিশৃংখলা বিরাজ করছে তা থেকে উত্তোরন সম্ভব। না হলে দিন দিন অপসংস্কৃতি আমাদের গ্রাস করবে এবং সমাজে চরম উৎশৃংখলতা দেখা দিবে। সংস্কৃতি কর্মকান্ডকে ভালোবাসে সবাই তাই এসব কর্মকান্ডকে সচল করে মানুষের মাঝ থেকে বিভিন্ন অসামাজিক অস্থিরতা দূর করা সম্ভব। আর এইসব কাজ সচল করতে হলে সরকারের পাশাপাশি সমাজের সাংস্কৃতিমনা মানুষেরদেরও এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।