রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলীয় নেতা থাকাকালে সাতক্ষীরার কলারোয়ায় তার গাড়িবহরে হামলার মামলায় আরো তিনজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। মঙ্গলবার সাতক্ষীরার মুখ্য বিচারিক হাকিম মোঃ হুমায়ুন কবীর তাদের জেরা ও জবানবন্দি রেকর্ড করেন। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের পিপি অ্যাড. আব্দুল লতিফকে সহায়তা করেন অতিরিক্ত এটর্ণি জেনারেল এসএম মুনীর, ডেপুটি এটর্ণি জেনারেল হাশেম আলী সরদার ও ডেপুটি এটর্ণি জেনারেল সুজিত চ্যাটার্জী বাপ্পি।

মঙ্গলবার আদালতে সাক্ষ্য দাতারা হলেন দৈনিক সাতনদী পত্রিকার সম্পাদক হাবিবুর রহমান, এনটিভির সাতক্ষীরা প্রতিনিধি সুভাষ চৌধুরী ও বাস চালক যশোরের শার্শার শেখ নজিবুল্লাহ। এনিয়ে এ মামলায় এ পর্যন্ত মোট সাক্ষ্য দিলেন মোট ১৮ জন। তবে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় সাক্ষী সাংবাদিক সুভাষ চৌধুরী শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলার বিষয়ে কোন কথা না বলায় শুধু মাত্র থানার ভিতরে আতঙ্কিত হয়ে দু’ ঘণ্টা অবস্থান করে সাধারণ ডায়েরী করার কথা উল্লেখ করায় রাষ্টপক্ষের আইনজীবীরা হতাশ হন।

একইভাবে মামলার বাদি মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার মোসলেম উদ্দিন, সাজেদুর রহমান খান চৌধুরী , উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম লাল্টুকে নতুন করে সাক্ষ্য নেওয়া ও মুক্তিযোদ্ধা শওকত হোসেন ও বাস চালক নজিবুল্লার সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন আদালত মঞ্জুর করে।

প্রসঙ্গত, ২০০২ সালের ৩০ আগষ্ট সকাল ১০টায় তৎকালিন বিরোধী দলীয় নেত্রী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা উপজেলার চন্দনপুর ইউনিয়নের হিজলদি গ্রামের এক মুক্তিযোদ্ধার ধর্ষিতা স্ত্রীকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে আসেন। তাকে দেখে যশোরে ফিরে যাওয়ার পথে সকাল ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে কলারোয়া উপজেলা বিএনপি অফিসের সামনে রাস্তার উপর জেলা বিএনপি’র সভাপতি ও তৎকালিন সাংসদ হাবিবুল ইসলামের হাবিবের নির্দেশে বিএনপি ও যুবদলের নেতা কর্মীরা দলীয় অফিসের সামনে একটি যাত্রীবাহি বাস রাস্তার উপরে আড় করে দিয়ে তার গাড়ি বহরে হামলা চালায়। হামলায় তৎকালিন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রকৌশলী শেখ মুজিবুর রহমান ও সাংবাদিকসহ কমপক্ষে এক ডজন দলীয় নেতা কর্মী আহত হয়।

এ ঘটনায় থানা মামলা না নেওয়ায় ওই বছরের ২ সেপ্টেম্বর কলারোয়া মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার মোসলেমউদ্দিন বাদি হয়ে যুবদল নেতা আশরাফ হোসেন, আব্দুল কাদের বাচ্চুসহ ২৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৭০/৭৫ জনকে সাতক্ষীরা নালিশী আদালত ‘ক’ অঞ্চলে একটি মামলা দায়ের করেন। বিচারক এম আই ছিদ্দিকী তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসএম গোলাম কিবরিয়াকে নির্দেশ দেন। থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ২০০৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঘটনা মিথ্যা বলে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন।

নিম্ন আদালতে বাদির পক্ষে রায় না হওয়ায় ২০০৪ সালের ৪ আগষ্ট বাদি এ আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে ক্রিমিনাল মিস কেস (৫৮৯৩/০৪) দাখিল করেন। দীর্ঘ শুনানী শেষে বিচারকদ্বয় ২০১৩ সালের ১৮ জুলাই আপিল মঞ্জুর করে নি¤œ আদালতের আদেশের উপর স্থগিতাদেশ দেন। একইসাথে নিম্ন আদালতে মামলার কার্যক্রম নতুন করে শুরু করার করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাদির উপস্থিতিতে নারাজির শুনানী করার জন্য মুখ্য বিচারিক হাকিম নিতাই চন্দ্র সাহা ২০১৪ সালের ১৫ অক্টোবর মামলাটি এজাহার হিসেবে গণ্য করার জন্য কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে আদেশ দিলে পরবর্তীতে মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক শফিকুর রহমান ৫০ জনের নাম উল্লেখ করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলাটি তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে এসটিসি ২০৭/১৫, এসটিসি ২০৮/১৫ দু’টি অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ-২য় আদালতে বিচারাধীন। টির ১৫১/১৫ মামলাটি মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে বিচারাধীন। ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই এ মামলায় বাদি সাক্ষী দিতে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অপর টিআর ১৫১/১৫ মামলাটি মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে বিচারাধীন ছিল।

মামলায় বাদি মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার শেখ মোসলেমউদ্দিনসহ নয়জন সাক্ষী দেন । তবে বাদিকে জেরা করেনি আসামীপক্ষ। ২০১৭ সালের ৯ ও ২৩ আগষ্ট আসামীপক্ষ মামলা তিনটির কার্যক্রম হাইকোর্টে স্থগিত করেন। দীর্ঘ তিন বছর পর উভয়পক্ষের শুনানীর পর আসামী পক্ষের মিসকেস খারিজ করে দিয়ে হাইকোর্ট ওই মামলাগুলি ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তি করার জন্য সংশ্লিষ্ট নিম্ন আদালতকে নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ি গত ০৪ নভেম্বর মামলার বাদি মোসলেমউদ্দিন আদালতে সাক্ষী দেওয়ার জন্য হাজিরা দেন। ওইদিন আসামীপক্ষের আইনজীবীরা হাইকোর্টে ক্রিমিনাল মিস কেস খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে তারা মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে লিভ টু আপিল দাখিল করেছেন উল্লেখ করে বলেন, চেম্বার জজ মামলাটি আমলে নিয়ে নিয়মিত মামলা হিসেবে ২২ নং ক্রমিকে রেখে আগামি বছরের ৪ জানুয়ারি শুনানীর জন্য দিন ধার্য করেছেন।

এ সংক্রান্ত আইনজীবীর প্যাডে লেখা সনদ তারা আদালতে উপস্থাপন করেন। বিকেলে বিচারক হুমায়ুন কবীর এ সংক্রান্ত শুনানী শেষে আসামীপক্ষকে সুপ্রিম কোর্টের আদেশের মূল কপি উপস্থাপন ও বাদির সাক্ষীর জন্য ১৭ নভেম্বর দিন ধার্য করেন। ১৭ নভেম্বর ও ২২ নভেম্বর তারা সুপ্রিম কোর্টে স্থগিতাদেশের কোন কপি মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে উপস্থাপন করতে পারেননি। ৩০ নভেম্বর পরবর্তী সাক্ষীর জন্য দিন ধার্য করা হয়। একপর্যায়ে ২৪ নভেম্বর ক্রিমিনাল মিস কেস ও স্থগিতাদেশ সংক্রান্ত আবেদন খারিজ করে দেয় আদালত। ফলে মূল মামলার কার্যক্রম চলমান রাখতে আর কোন বাধা রইল না।

সাতক্ষীরা জজ কোর্টের পিপি অ্যাড. আব্দুল লতিফ বলেন, পিপি অ্যাড. অতিরিক্ত এটর্ণি জেনারেল এসএম মুনীর, সহকারি এটর্নি জেনারেল হাশেম আলী সরদার ও সুজিত কুমার চ্যাটার্জী, সাতক্ষীরা জজ কোর্টের জ্যেষ্ট আইনজীবী অ্যাড. এসএম হায়দার আলীসহ অনেকেই রাষ্ট্রপক্ষে শুনানীতে অংশ নেন।

আসামী পক্ষে শুনানীতে অংশ নেন অ্যাড আব্দুল মজিদ(২), অ্যাড. মিজানুর রহমান পিন্টু, অ্যাড. আশরাফুল আলমসহ কয়েকজন।

অতিরিক্ত এটর্ণি জেনারেল এসএম মুনীর জানান, ২০০২ সালের ৩০ আগষ্ট কলারোয়ায় তৎকালিন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলা মামলাটি দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ২০১৪ সালের ১৫ অক্টোবর নতুন করে আলোর মুখ দেখে। ২০১৭ সালে মামলা তিনটি একজন নাবালকের কথা উল্লেখ করে উচ্চ আদালতে স্থগিত করলেও তা খারিজ হয়ে যায়। আসামীপক্ষ সুপ্রিম কোর্টে লিভ টু আপিল করলেও তা গত বৃহষ্পতিবার খারিজ হয়ে গেছে। তারা রাষ্ট্রপক্ষকে সাহায্য করতে এসেছিলেন। তছাড়া কলারোয়ার হিজলদি গ্রামের ওই ধর্ষিতার মামলাটি পূণরুজ্জীবিত করার জন্য তিনি সব ধরণের উদ্যোগ নেবেন।

(আরকে/এসপি/ডিসেম্বর ০১, ২০২০)