রাজারহাট (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি : ৬ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম ও রাজারহাট হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে কুড়িগ্রাম ও রাজারহাটকে পাক-হানাদার মুক্ত করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হলেও এ অঞ্চলে সেদিন উদিত হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। দিবসটি উপলক্ষে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন পৃথক পৃথক ভাবে সকালে র‌্যালী, পুস্পস্তবক অর্পণ ও স্থৃতিচারণমূলক আলোচনা সভার আয়োজন করেছেন।

এই দিনে মুক্তিবাহিনীর কেওয়ান এফএফ কোম্পানি কমান্ডার বীর প্রতীক আব্দুল হাই সরকারের নেতৃত্বে ৩৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল বিকেল ৪টায় কুড়িগ্রাম শহরে প্রথম প্রবেশ করেন। এরপর তারা নতুন শহরের ওভার হেড পানির ট্যাংকের ওপরে (বর্তমান সদর থানার উত্তরে অবস্থিত) স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে চারিদিকে ছড়িয়ে দেয় বিজয়বার্তা। সেদিন বিজয় মিছিলে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানাতে হাজারো মুক্তিকামী মানুষ রাস্তায় নেমে এসে মিলিত হয় জাতির সূর্য সন্তানদের সঙ্গে। ২৩০ দিন পাক হানাদার বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ থাকার পর মুক্ত হয় কুড়িগ্রাম।

জানা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কুড়িগ্রাম জেলার মানুষের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভুমিকা। ১৯৭১ সালে কুড়িগ্রাম জেলা ছিল ৮টি থানা নিয়ে গঠিত একটি মহকুমা। ১৯৭১ সালের ১০মার্চ মহকুমা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ১৭ মার্চ স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতারা চিলড্রেন পার্কে আনুষ্ঠানিকভাবে মানচিত্র আঁকা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। ২৫ মার্চের কাল রাতের পর সংগ্রাম কমিটি ২৮ মার্চ গওহর পার্ক ময়দানে জনসভা করে বেসরকারি হাইকমান্ড গঠন করে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে। ৩০ মার্চ রংপুরের ইপিআর উইং-এর সহকারী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন কিছু সঙ্গী-সাথী নিয়ে কুড়িগ্রামে চলে আসেন। তার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ১ এপ্রিল থেকে তিস্তা নদীর পূর্বপাড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ৪ এপ্রিল পাকবাহিনী দালালদের সহযোগিতায় তিস্তা নদী পাড় হয়ে লালমানিরহাট দখল করে নেয়। এরপর পাক বাহিনী ৭ এপ্রিল এবং ১৪ এপ্রিল দু’বার কুড়িগ্রাম দখলে ব্যর্থ হওয়ার পর ২০ এপ্রিল কুড়িগ্রাম শহর দখল করে নেয়।
এরপর থেকে দেশ মাত্রিকাকে মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে জুলাই মাস থেকে গেরিলা যুদ্ধ করে।

পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালনা করতে থাকে একের পর এক সফল অভিযান। ১৩ নভেম্বর উলিপুরের হাতিয়ায় পাকবাহিনী গণহত্যা চালায়। এদিন পাকবাহিনী পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধাসহ ৭৩৪জন নিরীহ মানুষকে দাগারকুটি বধ্যভূমিতে জড়ো করে হত্যা করে। ১৪ নভেম্বর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে জেলার ভূরুঙ্গামারী, ২৮ নভেম্বর নাগেশ্বরী, ৩০ নভেম্বর সমগ্র উত্তর ধরলা এবং ৬ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম শহরসহ সমগ্র জেলা হানাদার মুক্ত করে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় কুড়িগ্রাম জেলার অর্ধেক অংশ ছিল ৬ নং সেক্টর এবং বাকী অংশ ছিল ১১ নং সেক্টরের অধীনে। শুধুমাত্র ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন রৌমারী থানা ছিল মুক্তাঞ্চল। সেখানেই চলতো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী কুড়িগ্রামকে হানাদার মুক্ত করতে শহীদ হন ৯৯ জন মুক্তিযোদ্ধা।

এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা হারুনুর রশিদ লাল জানান,‘১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়া যেমন আমাদের গর্ব, তেমনি আমি যুদ্ধ করে আমার জন্মস্থান কুড়িগ্রামকে এই দিনে স্বাধীন করেছি এটাও আমাদের গর্ব। গোটা দেশ একদিনে স্বাধীন হয়নি, বিভিন্ন দিন বিভিন্ন অঞ্চল হানাদার মুক্ত হয়েছে-এই বীরত্বগুলোর গুরুত্ব রয়েছে। রাষ্ট্রের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকে এই বীরত্বগুলো জানানো এবং তাদের এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা আমাদের দায়িত্ব, সেই জায়গাটা আমাদের তৈরি করতে হবে।’

অপরদিকে এই দিনে বাংলার দামাল ছেলেদের প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানী হানাদাররা রাজারহাট ছেড়ে পালিয়ে যায়। হানাদার মুক্ত হয় এই অঞ্চল। ৭১’র ২৮ মার্চ কুড়িগ্রাম সংগ্রাম কমিটির নেত্বত্বে স্থানীয় গওহর পার্ক মাঠে এক বিশাল জনসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখান থেকে আহম্মদ আলী বকসী, অধ্যাপক হায়দার আলী, তাছাদ্দুক হোসেন ও মহির উদ্দিন আহম্মদকে নিয়ে স্থানীয় কমান্ড গঠন করা হয়। তাদেরই নির্দেশে বিভিন্ন থানা থেকে গোলাবারুদ, অস্ত্র সংগ্রহ করে তৎকালীন মহকুমা আওয়ামীলীগের সভাপতি আহম্মদ হোসেন সরকারের রাজারহাট উপজেলাধীন টগরাইহাট গ্রামের বাড়ীতে অস্ত্র মজুদ করা হয়। এর পর ওই বাড়ীতে স্থানীয় যুবক ও ছাত্রদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কলাকৌশল শেখানো হয়।

পরবর্তীতে রাজারহাটস্থ ওই বাড়ী থেকে প্রথমে পুলিশ-আনসার-ছাত্র ও স্থানীয় যুবকদের মধ্যে অস্ত্র বিতরন করে কুড়িগ্রাম অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করা হয়। ২৮ মার্চ রংপুরের ইপিআর উইং এর সহকারী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গার এক বাড়ীতে উঠেন। সেখান থেকে সংবাদ পাঠান রাজারহাট আওয়ামীলীগ নেতাদের কাছে। ২৯ মার্চ সকালে তৎকালীন আওয়ামীলীগ নেতা জহির উদ্দিন আহমেদ, আছমত উল্লাহ্ ব্যাপারী ও আলী মনসুর সেখানে যান। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিনের সাথে বৈঠক শেষে কুড়িগ্রাম আওয়ামীলীগকে বিষয়টি অবগত করেন।

৩০ মার্চ ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের নির্দেশে ওই উইং এর অধিনস্থ অধিনায়ক সুবেদার নুর মোহাম্মদ, সুবেদার আঃ মান্নান, সুবেদার আরব আলী ও বোরহান উদ্দিন তাদের সহযোদ্ধা ইপিআরদের নিয়ে রাজারহাট হয়ে কুড়িগ্রামে যান। ১লা এপ্রিল পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমন ঠেকাতে তিস্তা ব্রীজের অপর পাশে মুক্তিযোদ্ধারা একটি শক্তিশালী ঘাঁটি তৈরি করে। এসময় ইপিআর সদস্যরা রাজারহাট পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্যাম্প তৈরি করে। ৪ এপ্রিল পাকবাহিনী হারাগাছ দিয়ে তিস্তা নদী পার হয়ে লালমনিরহাটে অবস্থান নিলে মুক্তিযোদ্ধারা তিস্তার পূর্বপাড়ের ঘাঁটি রাজারহাট ও কুড়িগ্রাম নিয়ে আসেন। এর পর পাকবাহিনী দু’বার রাজারহাট আক্রমন করে।

অবশেষে মধ্য এপ্রিলে হানাদার বাহিনী রাজারহাট দখল করে নেয়। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী রাজারহাট দখল করে তাদের দোসরদের সহযোগীতায় সাধারন মানুষের ঘর-বাড়ীতে আগুন, লুটপাট, ধর্ষন ও গণহত্যা চালায়। অবশেষে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা বিগ্রেডিয়ার যোশীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৬ষ্ঠ মাউন্টেড ডিভিশনের সহযোগীতায় পাকবাহিনীর উপর পাল্টা আক্রমন চালিয়ে ৬ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম ও রাজারহাট একই দিনে মুক্ত করে।

(পিএস/এসপি/ডিসেম্বর ০৫, ২০২০)