শাহরিয়ার কবির


জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সংবিধানের অংশ। অতএব বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা করার অর্থ, সরাসরি রাষ্ট্রকেই অবমাননা করা। অতএব, যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার ঘোষণা দিয়েছে, যারা ভেঙেছে, তারা সরাসরি রাষ্ট্রের অবমাননা করেছে। তারা কোনো অবস্থাতেই ইসলামের পক্ষে নয়। ইসলাম সম্পর্কে তারা জানে না, এটাও স্পষ্ট বোঝা যায়। বরং তারা ইসলামকে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তান বানাতে চায়।

ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এই অপশক্তি প্রকৃতপক্ষে সন্ত্রাসী একটি গোষ্ঠী। তারা পাকিস্তান আমল থেকেই বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং সার্বিকভাবে বাঙালির বিরুদ্ধে। তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সন্ত্রাস ও অবিচারকে সমর্থন করেছে, একাত্তরে গণহত্যা করেছে। এখন তারাই আবার বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। ভাস্কর্য বিরোধিতা একটি উপলক্ষ মাত্র। তারা বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশকেই পাকিস্তানের চেহারা দিতে চায়।

এটা সবার কাছে পরিস্কার, ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তান রাষ্ট্রের সন্ত্রাস ও অনাচারের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ সংগ্রাম করেছেন। তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। বঙ্গবন্ধু কখনোই ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে আপস করেননি। তিনি ১৯৭২ সালে যে সংবিধান রচনা করেন, তার চার মূল নীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করেছেন। এই চার মূল নীতি নির্ধারণ করে বঙ্গবন্ধু তাকে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের মূল নীতি বলেও ঘোষণা দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন বলেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। সেই বাংলাদেশে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করেছে জিয়াউর রহমান এবং দেশকে ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা করেছে।

আমরা দেখতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দল আওয়ামী লীগ এই ধর্ম ব্যবসায়ীদের প্রশ্রয় দেবে না। যারা আজ ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব্যের নামে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে, তাদের গ্রেপ্তার করা হবে এবং কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, যারা ভাস্কর্য ভাঙার হুকুম দিয়েছে, উস্কানি দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কুষ্টিয়ার ঘটনায় কেবল মাদ্রাসা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা তো কারও কথায় বিপথে পরিচালিত হয়েছে। তাদের বিভ্রান্ত করে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু যারা বাংলাদেশের সংবিধানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, কোমলমতি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিপথে পরিচালিত করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? এই হুকুমদাতাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার একটা মামলা হয়েছে। একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি এই মামলা পর্যালোচনা করবে। কোনো দুর্বলতা থাকলে নির্মূল কমিটিও মামলা করবে।

ভাস্কর্য একটি দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। সৌদি আরব, তুরস্ক, ইরান, ইন্দোনেশিয়া সব দেশেই ভাস্কর্য আছে। ইসলামিক পি তদের ভাস্কর্য আছে। দেশে যারা ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে কথা বলছেন তারা কি সেই ইসলামিক পি তদের চেয়েও বড় হয়ে গেছেন? অবশ্যই না। আমি বলব না যে, তারা জানেন না। তারা জেনেবুঝেই বাংলাদেশকে পাকিস্তানি রাষ্ট্রের ভাবধারায় পরিচালিত করতেই বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা করছেন, দেশের সংবিবধানকে অস্বীকার করছেন এবং ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের প্রতি অমর্যাদা করছেন। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকেই কঠোরতম ব্যবস্থা নিতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।