স্টাফ রিপোর্টার : পর্যটননগরী কক্সবাজার। বাঁকখালী নদী বেষ্ঠিত কক্সবাজার সদর উপজেলার একটি ইউনিয়ন খুরুশকুল। জেলার সাথে খুরুশকুলের যোগাযোগ ব্যবস্থার সেতুবন্ধন হলো সংযোগ সড়ক। 

জেলা প্রশাসকের কাছে সংযোগ সড়কটি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সম্মুখযোদ্ধা মরহুম আব্দুল মজিদ কিংবা বীর মুক্তিযোদ্ধা এসএম নূর উন নবীর নামে নামকরণ করার দাবি জানিয়ে সোমবার দুপুরে খোলা চিঠি দিয়েছেন কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদের সভাপতি মোরশেদ হোসাইন তানিম।

১৯৩৬ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক গঠিত পাটালি মাছুয়াখালী ও খুরুশকুল ইউনিয়ন বোর্ড বৃহৎ ও জনবসতিপূর্ণ হওয়ায় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ১৯৫৯ সালে স্বতন্ত্র দুটি ইউনিয়নে বিভক্ত করে দুটি ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠন করে। ১৯৭৩ সালে ইউনিয়ন কাউন্সিলের নাম পরিবর্তন করে ঘোষণা করা হয় খুরুশকুল ইউনিয়ন পরিষদ।

সোমবার ১৪ ডিসেম্বর বিকেলে কোর্টহিল ডিসি অফিসে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের মো. কামাল হোসেন এর হাতে খোলা চিঠিটা তুলে দেওয়া হয়।

এতে মোরশেদ হোসাইন তানিম জানান, তাঁহার পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা এসএম নূর উন নবী। পরিবারটি কক্সবাজার পৌরসভার খুরুশকুল নতুন রাস্তার মাথা (৫নং ওয়ার্ড) সংলগ্ন এলাকায় বহু শতাব্দী ধরে বসবাস করে আসছেন।

খোলা চিঠিতে উল্লেখ করেন, ১৮৮৮-৮৯ সালের সিএস জরীপে তৃতীয় পোরশনের ১৫১১-১৫১৫ দাগ পর্যন্ত তাদের নামীয় ৪ নং খতিয়ান ও ১৯২৬-২৭ ইং সনের আরএস জরিপের ৯০৮ দাগের ২৩ নং খতিয়ান ও ১৯৫৯-৬০ ইং আমআরআর জরিপের ৪৬৩৪ দাগের ৮৭ নং খতিয়ান ও ১৯৭২-৭৫ ইং বিএস জরিপের ১১৩২৭- ১১৩৩০ পর্যন্ত ৬৪০, ৯৬৬ খতিয়ান মতে আমাদের চুড়ান্ত প্রচার রয়েছে।

শহরের ২০-২৫ টি পয়েন্টে পরিবারটির জমির উপর দিয়ে সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য সড়ক ও চলাচলের পথ হলেও কখনো কোন ক্ষতিপূরণ দাবী করেনি। প্রায় সময় সড়ক সম্প্রসারণে সহযোগিতা করেছেন।

বর্তমানে খুরুশকুল রোড সংলগ্ন এই সংযোগ সড়কের জায়গা সমূহ তাদের পূর্ব পুরুষগণ সরকারকে সড়ক প্রশস্ত করণে দান করেন। যা খতিয়ান ও দলিল স্পষ্ট রয়েছে। তৎকালিন নীল কর বিদ্রোহ , স্বদেশী আন্দোলন, জোতদ্বারদের বিরুদ্ধে আন্দোলনসহ বৃ‌টিশ সৈন্য‌দের বিরু‌দ্ধে মাষ্টার দা সূর্য‌সে‌নের সহ‌যোদ্ধা হি‌সে‌বে ধলঘাট সম্মুখ যু‌দ্ধে শরীক ছিলেন।

বৃ‌টিশ বিরোধী আন্দোলন গ‌ড়ে তুল‌তে ও মানুষ‌কে প্র‌তিবাদ মুখর হিসেবে গড়ে তোলতে বৃ‌টিশ‌দের অন্যা‌য়ের প্র‌তিবাদ কর‌তে উৎসাহ যুগিয়েছিলেন। সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছেন মরহুম আব্দুল মজিদ প্রকাশ ম‌জিদ আলী ।

তৎকালীন সময়ে ব-দ্বীপের ওই অংশ জলদস্যু মুক্ত করতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি বার বার তৎকালীন বৃ‌টিশ সরকা‌রের বিরু‌দ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে হুলিয়াসহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রেখেছিলেন।

গরীব কাটুরিয়াদের নিকট থেকে পাঁচ ক‌ড়ির বদ‌লে সাত কড়ি পরবর্তী‌তে দশ ক‌ড়ি কর আদায় থেকে তিনি ইংরেজদের বিরু‌দ্ধে প্রথম প্র‌তিবাদ ক‌রেছিলেন। বৃ‌টিশ সরকা‌রের শোষণ ও নির্যাত‌নের বিরু‌দ্ধে রুখে দাঁড়াতে ‌গি‌য়ে ক‌য়েকবার কুতুব‌দিয়া‌ দ্বীপে নির্বা‌সিত হয়েছিলেন। হু‌লিয়া জা‌রি হ‌লে প‌রে প‌রিবা‌রের সদস্যরা বৃ‌টিশ সৈন্য‌দের হা‌তে বার বার নিগৃহীত হন।

কক্সবাজার থে‌কে পূর্ব পুরু‌ষের বা‌ড়ি প‌টিয়া‌তে চ‌লে যান এবং সেখা‌নেই বৃ‌টিশ বিরোধী আন্দোল‌নের অন্যতম নেতা মাষ্টার দা সূর্য সে‌নের হাত ধ‌রে ইং‌রেজ‌দের বিরু‌দ্ধে প‌রিক‌ল্পিত আন্দোল‌নের সূচনা ক‌রেন। আন্দোল‌নের সূচনাল‌গ্নে তি‌নি চট্টগ্রামে‌র গোপন দ‌লের সদস্য হন ও প্রকা‌শ্যে এবং গোপ‌নে বিপ্লবী কর্মকান্ড প‌রিচালনা ক‌রেন দ‌লের নি‌র্দে‌শে।

চট্টগ্রা‌মে সংগঠ‌নের বিপ্লবী কর্মকান্ড‌কে শ‌ক্তিশালী কর‌তে গোপন দ‌লের নি‌র্দে‌শে সহ‌যোদ্ধা চট্রগ্রা‌মের (সম্ভবত) জামালখান বা নবাব সিরা‌জ উদ-দৌলা সড়‌কের সম্ভ্রান্ত প‌রিবা‌রের এক মে‌য়েকে বৈবা‌হিক সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নিলেও ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ আক্রমণ ও তৎপরবর্তী মাষ্টার দা সুরেশ সেন গ্রেফতার হবার কার‌ণে তা ‌সম্ভব হয়নি ।

জনশ্রু‌তি আছে বিপ্লবী দ‌লের ঐ নারী সদস্য চিরকুমারী হি‌সে‌বে ছি‌লেন ও শিক্ষকতার মাধ্য‌মে জীবন অতিবা‌হিত ক‌রেন। তৎ পরবর্তী‌তে তি‌নি কক্সবাজার চ‌লে আসেন ও মে‌হেরু‌ন্নেসার সা‌থে বিবাহ বন্ধ‌নে আবদ্ধ হন ।

সেই নেতার প্রথম পুত্র মরহুম নজির হোসেন মিস্ত্রী তানিমের দাদা হন। যিনি পারিবারিক বিশাল সম্পদের মালিক হলেও পৈত্রিক সম্পদের মোহ ছেড়ে পরিশ্রমে বড় হবার স্বপ্ন দেখেন। পরবর্তীতে তিনি হয়ে উঠেন ভারত, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান এবং বার্মার অনেক বড় ঠিকাদার , যিনি কক্সবাজার জেলার শিক্ষা বিস্তারের মহান ব্রত নিয়ে কক্সবাজার সরকারী কলেজ স্থাপনের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়ান।

কলেজের বর্তমান জমির অধিকাংশ মায়ের কাছ থেকে ওয়ারিশ সুত্রে পাওয়া অংশ ও আত্বীয়দের বিশাল অংশ কলেজের জন্য দান করতে বাধ্য হন। কলেজ স্থাপনে প্রয়োজনীয় আর্থিক দৈহিক ও মানসিকভাবে সহযোগীতা করেন। তাঁর হাতেই ভারতবর্ষের অসংখ্য সড়ক, ব্রীজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বন্দর, স্কুল কলেজ তিনি সুনামের সহিত নির্মাণ করেন । যাকে তৎকালীন সময়ে নজির হোসেন মিস্ত্রী নামে খুব বেশী পরিচিত ছিল।

কক্সবাজার শহরে প্রথম দুই তলা বিশিষ্ট বিশাল বাড়ি তৈরি করেন। কক্সবাজার শহরের প্রথম বিদ্যুৎ ব্যবহার করে লাইট, ফ্যান চালান। শহরের প্রথম টেলিভিশন ও ঐতিহ্যবাহী টিএন্ড টি ফোন সর্বসাধারণের উন্মুক্ত করেন।

শহরের বিভিন্ন স্থানে জনবসতি বাড়াতে বিশ হাজারেরও অধিক মানুষকে নিজের বা পরিবারের জমিতে বসতি স্তাপন করতে সহযোগিতা করেন। যিনি অসংখ্য কুয়া, জলাধার, স্কুল , কবরস্থান, মসজিদ স্থাপন করেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কক্সবাজার শহর ও খুরুশকুলের অধিকাংশ সংখ্যালঘু পরিবারের শত শত মানুষকে রাজাকার ও হানাদারদের কাছ থেকে রক্ষা করতে মাসের পর মাস তাদের সকল খাদ্য সরবরাহ করে নিরাপদ ‌রাখেন ।

যার সূত্র ধরে পাকবাহিনী অসংখ্যবার উনার বাড়ীতে হামলা করে গুলি করেছিলো বৃষ্টির মত। ঝাঝরা করেছে বার বার বিশাল বাড়ির দেয়ালগুলো। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধুর নি‌র্দেশ অনুসা‌রে শহ‌রেই নি‌জে‌দের শত বিঘা জ‌মি থাক‌লেও বিশ বিঘার বে‌শি জ‌মি বিএস এর অন্তর্ভুক্ত ক‌রেন নি।

মোরশেদ হোসাইন তানিম খোলা চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, বঙ্গবন্ধু তাদের পরিবা‌রের তিন বিঘা দখলীয় চাষী জ‌মি আবুল বশর নামক এসডিওর ড্রাইভা‌রের নিকট ব‌ন্দোবস্তি করার সুযোগ দিয়েছিলেন। যা তাদের‌ প‌রিবা‌রের আরএস, এমআরআর ও বিএস খ‌তিয়া‌নের অন্তর্ভুক্ত করেন ।

১৯৭১ সা‌লে মু‌জিব বাহিনীর যু‌দ্ধের প্র‌শিক্ষ‌ণের প্রস্তু‌তি স্বরুপ ড্যা‌মি রাই‌ফে‌লে ট্রে‌নিং শুরু থে‌কে চুড়ান্ত প্রস্তু‌তি পর্যন্ত মু‌জিব বা‌হিনী গঠ‌নে তার পিতা সাধ্যমত সহ‌যো‌গিতা ক‌রেন। যে বা‌হিনীর অন্যতম সদস্য ছিলেন এসএম নূর উন নবী।

যিনি কক্সবাজার জেলা ব্যা‌পি শিক্ষার হার বাড়া‌তে প্র‌তি বছর বিনামূ‌ল্যে পাঠ্য পুস্তক বিতরণ সহ, গরীব অসহায় ছাত্র ছাত্রী‌দের শিক্ষার ব্যয় বহন ক‌রেন। সমা‌জের পি‌ছি‌য়ে পড়া নারী‌দের স্বাবলম্বী কর‌ে গ‌ড়ে তু‌লতে নারী কল্যাণ স‌মি‌তি ও সত্যান্বেষী নামক দুস্থ ম‌হিলা‌দের সেলাই প্র‌শিক্ষণ কেন্দ্রসহ বি‌ভিন্ন ধর‌নের কু‌টির শি‌ল্পের কাজ, সেই সা‌থে চিন্নমূল নারী‌দের বিনামূ‌ল্যে সেলাই মে‌শিন বিতরণ ও সরকা‌রের বি‌ভিন্ন উৎস থে‌কে সহজ শ‌র্তে ঋন দা‌নের সহ‌যো‌গিতার পাশাপা‌শি সমাজের অসহায় নির্যাতিত মানুষের পক্ষে লড়াই করেছিলেন।

স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ৬২ , ৬৬ ও ৬৯ এর গণআন্দোল‌নে ‌ ছি‌লেন প্রথম কাতা‌রে। এদে‌শে প্রথম পা‌কিস্তা‌নের পতাকা পুড়ানো তি‌নিই বীর মৃ‌ক্তি‌যোদ্ধা প্রয়াত সুরুত আল‌ম ছাত্রলীগকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সমগ্র জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চ‌লে শিক্ষকতা করেন ও হাজার হাজার মু‌ক্তিযু‌দ্ধের সপ‌ক্ষের শ‌ক্তি‌কে শ‌ক্তিশালী ক‌রেন।

বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় ইংরেজ সৈন্যরা বার বার আমাদের পরিবারের উপর জুলুম নির্যাতন করেছে, তেমনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জঙ্গি বিমান থেকে তিনটি বোমা ফেলা হয়েছিল আমাদের বাড়ি লক্ষ্য করে যার ক্ষত চিহ্ন এখনো বিদ্যমান। তেমনি ১৯৭১ সালে পাক সেনাদের নিপীড়ন ও অবর্ননীয় অত্যাচার ও গুলির চিহ্ন বাড়ির দেয়াল জুড়ে ছিল, ৯০ এর স্বৈরচার বিরোধী আন্দোলনেও আমার বাড়িকে ঘিরে প্রধান সড়কে হয়েছিল সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ যাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন আমার এক চাচাসহ অনেকে।

সুতরাং ইতিহাসকে তার স্বাভাবিক পথে পরিচালিত করতে আমাদের পরিবারের নামেই সড়কটি করার দাবি আপামর জনতার। সংযোগ সড়কটি পিতামহ মরহুম আব্দুল মজিদ কিংবা আমার পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম নূর উন নবী এর নামে সড়কটি নামকরণ করা হলে বর্তমান প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস ঐতিহ্য জানবে বলে প্রত্যাশা করি।

মোরশেদ হোসাইন তানিম আরো জানান, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক ও পৌর প্রশাসককে খোলাচিঠিতে লিখিত আকারে আমার পরিবারের মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা তুলে ধরেছি। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আমলে নিয়ে তাঁরা যথাযথ
ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।'

(জেজে/এসপি/ডিসেম্বর ১৬, ২০২০)