মো. আব্দুল কাইয়ুম, মৌলভীবাজার : স্বাধীনতা উত্তর ভাটিবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের অজপাড়া গাঁয়ে দুঃসহ  যন্ত্রণার মধ্যদিয়ে যাচ্ছিল দিনগুলো। অভাব অনটনের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। সেই পরিস্থিতিতেও স্বপ্ন  দেখতেন গ্রাম থেকে দুইশত কিলোমিটার দূরের শহুরে পরিবেশে সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে কিভাবে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায়। যে নারী সন্তানদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার এমন প্রাণপণ লড়াইয়ের আকাঙ্খা মনে জাগ্রত করতেন তিনি হলেন সফল জননী নারী ক্যাটাগরিতে জয়িতা পুরস্কার প্রাপ্ত সংগ্রামী নারী সুকৃতি ভৌমিক।

গত ৯ ডিসেম্বর বুধবার নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া দিবসে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ কর্মসূচির আওতায় মৌলভীবাজার জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচিত ১০জন জয়িতাদের মাঝে পুরস্কার প্রদান করেন। অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জন,শিক্ষায় সাফল্য অর্জন,সফল জননী নারী,নির্যাতন বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা নারী এবং সমান উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখা নারীসহ ৫ ক্যাটাগরিতে জেলা পর্যায়ে যে ৫জন সফল নারী জয়িতা পুরস্কার পেয়েছেন তাদের অন্যতম সুকৃতি ভৌমিক।

প্রান্তিক জনপদ ছেড়ে শহরে এসে নিজের সন্তানদের আলোকিত মানুষ গড়ার প্রবল ও অদম্য ইচ্ছে শক্তিই এ নারীকে কন্টকাকির্ণ পথচলা শেষে সফল সংগ্রামী জননী হিসেবে জয়িতা পুরস্কারের স্বীকৃতি দিয়েছে জীবন সায়াহ্নে। এর আগে ২০১৫ সালের দিকে সিলেটের রামকৃষ্ণ মিশনের পক্ষ থেকেও জয়িতা পুরস্কার পান তিনি। প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদের আলো বাতাসে বেড়ে উঠা সংগ্রামী নারী সুকৃতি ভৌমিক কিভাবে আত্মপ্রত্যয়ী সফল একজন নারী হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন কিভাবে এই লেখায় তাঁরই আলোকপাত।

ভাটি বাংলার জেলা সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার আশারকান্দি ইউনিয়নের শুক্লাম্বরপুর গ্রামের বৈদ্যুতিক আলোবিহীন গ্রামীণ জনপদে কুপি বাতির আলোয় শুরু হয় সুকৃতি ভৌমিকের জীবন সংগ্রামের কঠিন পিচ্ছিল পথ। দেশ স্বাধীনের পর সন্তানদের মানুষ করার প্রত্যয়ে গ্রাম ছেড়ে দূরের শহরে চলে আসেন সফল এ জননী। অতঃপর শুরু ভিন্ন গল্পের কঠিন যাত্রা পথ।

সুকৃতি ভৌমিকের স্বামী ছিলেন ভাটি বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত দীঘলবাঁক উচ্চ বিদ্যালয়ে সহজ সরল একজন স্কুল শিক্ষক। থাকতেন সেখানকার প্রাচীন জনপদ শুক্লাম্বরপুর গ্রামের বাড়িতে। স্বল্প আয়ের অভাব অনটনের সংসার। সংসারের ঘানি টানতে টানতে প্রতিনিয়ত ক্লান্ত সুকৃতি ভৌমিক নিরবে নিভৃতে ভাবতেন,এই বিদ্যুতবিহীন অজপাড়া গাঁয়ে থেকে,সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক এলাকায় বসবাস করে ছেলে-মেয়েদের মানুষ করব কীভাবে?

তাঁর অদম্য ইচ্ছে,যেভাবেই হোক শত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও সন্তানদের তিনি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করবেনই। আর এজন্য যেতে হবে গ্রাম ছেড়ে বহু দূরের শহরে। তবে তাঁর এমন ইচ্ছে শক্তির কথা খুব বেশি সময় গোপন রাখেননি তিনি। দ্রুত ই স্বামীকে এ ব্যাপারে নানাভাবে উৎসাহিত করতে থাকেন।

তবে স্বপ্ন আর বাস্তবতার ফারাক মাথায় নিয়ে ভাবেন তিনি,কল্পনায় তো স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় না! তার জন্য প্রয়োজন অর্থের যোগান। আত্মপ্রত্যয়ী সুকৃতি ভৌমিকের স্বামী স্ত্রী সুকৃতি ভৌমিককে বুঝাতে গিয়ে বলেন,ওখানে গিয়ে আমরা কী পারবো? এখানে পুকুরের মাছ আছে,ক্ষেতের চাল আছে,গোলাভরা ধান আছে,বাড়ির তরতাজা সব্জি আছে,এমনকি চুলা ধরানোর লাকড়িও আছে।

শহরে গিয়ে তো সবই কিনতে হবে। সে অর্থ আমাদের কই! মাসে যে বেতন পাই,তাতে তো চলে যাবে শুধু চুলা ধরানোর লাকড়ির পেছনেই। স্বামীর এমন কথায় সুকৃতি ভৌমিক কিছুটা পিছু হটলেও হতোদ্যম হলেন না। বুকভরা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলেই ফেললেন,’তুমি কোনো চিন্তা করোনা। আমি প্রয়োজনে গাছের পাতা জ্বালিয়ে রান্না করবো। আধপেটা খেয়ে সন্তানদের মানুষ করবো, তবু তোমাকে কখনোই কোনো ব্যাপারে বিরক্ত করবো না। তুমি একটা বাঁশের ঘর বানিয়ে আমাকে মৌলভীবাজার রেখে আসো’। স্ত্রীর এমন অদম্য আকুতির কাছে হার মানলেন দরিদ্র ও স্বল্পবেতনভোগী স্কুলশিক্ষক।

১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতার পরের বছরই সুকৃতি ভৌমিক সন্তানদের নিয়ে চলে আসেন মৌলভীবাজার শহরের শান্তিবাগে,সেখানে স্বামীরই আরেক পৈতৃক ভিটায়। অতঃপর শুরু হয় তাঁর কঠিন সংসার জীবনের মহাসমুদ্র পারাপারের গল্প। নিজের সন্তানদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে গিয়ে লুকিয়ে আছে কত ত্যাগ,কত তিতিক্ষা আর বঞ্চনার দুঃখগাঁথা।

পাঁচ ছেলে আর একমাত্র কন্যা সন্তানের গর্বিত জননী সুকৃতি ভৌমিক ছয় সন্তানকেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পেরেছেন। বড় ছেলে বনমালী ভৌমিক অতিরিক্ত সচিব হয়ে অবসরে যান। বর্তমানে দেশের অন্যতম প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় লিডিং ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর পদে কর্মরত আছেন। মেজো সন্তান পার্থ সারথি ভৌমিক একজন সফল ব্যবসায়ী। সেজো ছেলে বিমলেন্দু ভৌমিক ঢাকা সরকারি বিজ্ঞান কলেজের রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত আছেন। একমাত্র কন্যা সন্তান কৃষ্ণা ভৌমিক গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে আমেরিকা প্রবাসী হয়েছেন দুযুগেরও অধিক কাল ধরে। পঞ্চম সন্তান ডা.বিনেন্দু ভৌমিক পেশায় চিকিৎসক হিসেবে বর্তমানে মৌলভীবাজার সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। কনিষ্ঠ সন্তান ইঞ্জিনিয়ার ড. সুকান্ত ভৌমিক কানাডার ওন্টারিওর উইন্ডসর ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা ও গবেষণায় নিয়োজিত আছেন।

জয়িতা পুরস্কার প্রাপ্ত সফল নারী সুকৃতি ভৌমিক এর সন্তান ডা.বিনেন্দু ভৌমিক একজন মেধাবী চিকিৎসক। বর্তমানে মৌলভীবাজার সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

মা সুকৃতি ভৌমিকের সংগ্রামী জীবনের নানা উপখ্যান নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাবা ছিলেন,স্কুল শিক্ষক সেই সুবাদে প্রতিটি সন্তানদের প্রচুর শ্রম আর সময় দিয়ে পড়াতেন,যার কারণে আমরা ভাই-বোন সবাই বাবার অবদানে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি।

তিনি বলেন,দেশ স্বাধীনের পর আমার মা যখন আমাদের নিয়ে আমাদের শান্তিবাগের বাসায় বসবাস শুরু করলেন তখন সেখানে বিদ্যুৎ ছিলনা,আমাদেরকে সন্ধার পর পাতা জ্বালিয়ে পড়ার সুযোগ করে দিতেন আমাদের মা। আবেগ আপ্লুত হয়ে তিনি বলেন,অভাব অনটনের সংসার তাই সন্তানদের মানুষ করতে গিয়ে কখনো ভাল কাপড় জুটেনি মায়ের। ১৯৮৪ সালে প্রথমে বৃত্তির টাকা হিসেবে পাই ২শত ৫০ টাকা। সেই টাকা দিয়েই প্রথমে মায়ের জন্য আমি ভাল একটি শাড়ি উপহার হিসেবে দেই,এটিই ছিল আমার মায়ের প্রথম পাওয়া একটি ভাল মানের শাড়ি।

(একে/এসপি/ডিসেম্বর ১৭, ২০২০)