রণেশ মৈত্র


বীর মুক্তিযোদ্ধা কমলেশ বেদজ্ঞরা চার জন গোপালগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের অসীম সাহসী সৈনিক ১৯৭৩ সালের ১৩ মার্চ নির্মমভাবে খুন হন। চাঞ্চল্যকর এই খুনের আসামী তাঁরই গ্রুপের কমান্ডার বীর বিক্রম হেমায়েত উদ্দিন। কমলেশ বেদজ্ঞ ছিলেন ঐ একই গ্রুপের ডেপুটি কমান্ডার।

গোপালগঞ্জে পাক হানাদার বাহিনী ঢুকেছিল একাত্তর সালের ৩০ এপ্রিল। খুন-লুঠ-অগ্নিসংযোগে-শ্মশানে পরিণত হয়েছিল গোপালগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা। জয়নাল, মিন্টু, রবিউল, ইমান উদ্দিনসহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা এবং অধ্যাপক সন্তোষ কুমার দাস, প্রবীণ শিক্ষাবিদ গোবিন্দ ঠাকুর সহ শত শত মানুষের রক্তেস্নাত হয়ে গোপালগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয়। গোপালগঞ্জ শত্রুমুক্ত করতে বেশীরভাগ যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিরেন হেমায়েত বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার কমরেড কমলেশ বেদজ্ঞ। শুধু গোপালগঞ্জই নয়, মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টরে হেমায়েত বাহিনীর এই ডেপুটি কমান্ডার রাজাপুর, রামশীল, সেনারকান্দি পয়সারহাট, ভাঙ্গা, পাইকার বাড়ী, সিকিরবাজার ও ঘাঘরের যুদ্ধসহ ঐ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ সমূহ অসীম সাহসিকতার সাথে তাঁর নেতৃত্বে বিজয় অর্জিত হয়েছিলো।

সেই সাহসী মুক্তিযোদ্ধা কমলেশ বেদজ্ঞ ছিলেন গোপন কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য ও প্রকাশ্যে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ওয়ালী-মোজাফ্ফর এর নেতা)। তাঁদের খুনের আসামী হেমায়েত বাহিনী প্রধান হেমায়েত উদ্দিন ছিলেন একজন ছাত্র লীগ নেতা। তিনি সহ এই ঘটনা সংক্রান্ত মোকর্দমায় মোট আসামীর সংখ্যা ২১জন। এঁদের মধ্যে বর্তমানে বেঁচে আছেন মাত্র ছয় জন। হেমায়েত উদ্দিনসহ ১৫ জনই মামলা বিচারাধীন থাকাকালেই মৃত্যু বরণ করেছেন।

পঁচিশটিরও বেশী সফল যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা কমলেশ বেদজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে দেশ পুনর্গঠনের ইতিহাসে গোপালগঞ্জ বাসীর সুপরিচিত একজন বামনেতা। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের প্রায় পাঁচ দশক হতে চললো-আজও বিচার পান নি তাঁর পরিবারের সদস্যরা ও তাঁর অনুসারী, সারা দেশের অসংখ্য ভক্ত তাই ক্ষুব্ধচিত্তে তাকিয়ে আছেন আদালতের দিকে দীর্ঘ ৪৭ টি বছর ধরে।

হাইকোর্ট মামলাটি ছয় বার স্থগিত করেন। সর্বশেষ ২০১৫ সালে হাইকোর্ট মামলাটি খারিজ করে দেয়। পরবর্তীতে আবার সুপ্রিম কোর্ট স্থগিত করে। এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে কমলেশ বেদজ্ঞের মেয়ে সুতপা জানান, মার্শাল ল কোর্টে এই বিচার প্রক্রিয়াকে চিরতরে বন্ধ করার চেষ্টা হয়েছে। সরকার বাদী এই মামলাটিকে হাইকোর্ট বার বার স্থগিতাদেশ দিয়েছে। বারবার আদালত বদল হয়েছে। ১৯৯৮ সালে আবার বিচার প্রক্রিয়া সুরু হয় কিন্তু প্রভাবশালীদের চাপে বিচার প্রক্রিয়া স্বাভাবিক গতিতে এগুতে পারে নি।

২০১৫ সালে মামলাটির স্থগিতাদেশ খারিজের আবেদন ঊর্ধ্বতন আদালতদ বাতিল করার প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট মামলাটি বিরতিহীনভাবে বিচার করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির আদেশ দেন। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আদেশে বিচারকার্য্য স্থগিত রয়েছে। ইতোমধ্যে হেমায়েত উদ্দিনসহ অধিকাংশ আসামীর মৃত্যু হয়েছে। বেঁচে আছেন মাত্র ছয় জন।

কিভাবে খুন হন কমলেশ বেদজ্ঞসহ ৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা? তৎকালীন ছাত্র নেতা মামলার বাদী ও জেলা কৃষক লীগ সভাপতি লুৎফর রহমান পঞ্জর দেওয়া এজাহারের বিবরণ অনুযায়ী ওই দিন মুক্তিযোদ্ধা ওয়ালিউর রহমান লেবু, কমলেশ বেদজ্ঞ, বিষ্ণুপদ কর্মকার, রমাপ্রসাদ চক্রবর্তী মানিক ও লুৎফর রহমান পঞ্চর কোটালিপাড়া থেকে গোপালগঞ্জ যাওয়ার পথে টুপুরিয়ায় বেশ কয়েকজন অকস্মাৎ ঐ মুক্তিযোদ্ধাদের উপর দা, নিড়ানি, ছেনি, শাবল ও কোদাল নিয়ে হামলা চালায়। পৈশাচিক হামলায় ৪ জন ঘটনাস্থলেই মারা যান। বাদীকে মৃত ভেবে ফেলে রেখে যায়।
এত বড় সত্য ঘটনার বিচারে এখন পর্য্যন্ত আদালত কোন সাক্ষ্য নিতে পারে নি।

গ্রামবাসী পাঁচজন ডাকাতকে হত্যা করেছে এমন খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে ৪ মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ দেখতে পায়। লুৎফর রহমান পঞ্জর (বাদী) কে সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। হত্যাকাণ্ডের দু’দিন পর মারাত্মকভাবে আহত লুৎফর রহমান পঞ্জর মৃত্যুকালীন জবানবন্দী দেন। জবানবন্দীতে তিনি হেমায়েত উদ্দিন ও তার সঙ্গীদের পৈশাচিকতার বিবরণ তুলে ধরেন।

কমরেড কমলেশ বেদজ্ঞের কন্যা সুতপা বেদজ্ঞের বয়স ছিল তখন মাত্র আড়াই বছর। পিতার তেমন কোন স্মৃতি না থাকলেও বেড়ে উঠেছেন এক ভয়ার্ত পরিবেশে। কমলেশ বেদজ্ঞ হত্যার পর আতংকে কোটালি পাড়া ছেড়ে গোপালগঞ্জ গিয়ে থাকতে হয় সুতপা ও পরিবারের অপর সকল সদস্যকে। সেখানেও ছিল নানা রকম হুমকি। মুক্তিযুদ্ধে বাবার দুঃসাহসী ভূমিকার কথা শুনেছেন বাবার সহযোদ্ধাদের কাছে ও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দলিল গ্রন্থ থেকে। স্বাধীন দেশে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অপর তিনজনের নির্মম খুনের ব্যাপারে সুতপা বলেন, জুন মাসে আগৈলঝরা যুদ্ধে হেমায়েত উদ্দিন আহত হওয়ার পর বিভিন্ন এলাকার যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন তাঁর বাবা কমলেশ বেদজ্ঞ। ভারতীয় নৌবাহিনীতে অতীতে চাকুরীর সুবাদে উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কমলেশ বেদজ্ঞ যুদ্ধের কৌশল ভাল জানতেন। স্বাধীনতার পর তিনি জনসেবায় ও দেশ পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। ঐ সময়ে “সেড দ্য চিলড্রেন” এ চাকুরীর সুবাদে সর্বক্ষণিক মানুষের পাশে থাকতেন।

১৯৭৩ সালে সাধারণ নির্বাচনে কমলেশ বেদজ্ঞ ফরিদপুর-১১ আসনে ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টির সমর্থনে অংশ নেন কমলেশ বেদজ্ঞ। যুদ্ধকালীন রাজাকার ক্যাম্পের পতন ঘটিয়ে প্রাপ্ত সম্পদ মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতে চলে যাওয়া অনেক সম্পদ হেমায়েতের কাছে গচ্ছিত রাখা হয়েছিল। কমলেশ বেদজ্ঞের ডায়েরীতে মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনার বর্ণনা ছিল।
যুদ্ধের পর কমলেশ বেদজ্ঞ বারবার হেমায়েত উদ্দিনকে ঐ সম্পদ ফেরত দেওয়ার দাবী জানান কিন্তু হেমায়েত উদ্দিন তা ফেরত দিতে রাজী হন নি। তখন কমলেশ বেদজ্ঞ হেমায়েত উদ্দিনকে বলেন, জনগণের ঐ সম্পদ জনগণকে ফিরিয়ে না দিলে তিনি ঐ সম্পদের পুর্ণাঙ্গ তালিকা জনগণের কাছে প্রকাশ করবেন। এই চ্যালেঞ্জই কমলেশ বেদজ্ঞের হত্যার মূলকারণ বলে মনে করেন তাঁর প্রায় ৫০ বছর বয়সী মেয়ে সুতপা। সুতপা বলেন, বাবা হত্যার বিচার চেয়ে আইনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন তাঁর দাদু কার্তিক বেদজ্ঞ। স্বামী হত্যার বিচার পান নি আমার মা প্রয়াত ঊমা দেবী। আমিও জীবদ্দশায় এই মামলার রায় শুনতে পাব কিনা জানি না।

অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব গাথার স্বীকৃতিও পান নি কমলেশ বেদজ্ঞ। এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমির উপ-পরিচালক ‘মুক্তিযুদ্ধে গোপালগঞ্জ’ গ্রন্থের লেখক ড. তপন বাগচী সাংবাদিকদেরকে বলেন, “গোপালগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধে হেমায়েত বাহিনীর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশী। এই বাহিনীর সেকে--ইন কম্যা- ছিলেন কমলেশ বেদজ্ঞ। যুদ্ধে মূল দায়িত্ব পালন করেছেন কমলেশ বেদজ্ঞই। প্রতিটি প্রতিরোধ যুদ্ধেই তিনি অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। মূল পরিকল্পনা প্রণয়ন, আক্রমণের ছক তৈরী সহ যাবতীয় কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, স্বাধীন দেশে কমলেশ বেদজ্ঞ সহ চারজনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় আর সেই খুনের আসামী ছিলেন তাঁরই দল প্রধান। খুনের দায় মাথায় নিয়ে হেমায়েতও আজ প্রয়াত”।

সুতপা দাবী করেন দ্রুত তাঁর বাবা হত্যার সুবিচার, বাবা কমলেশ বেদজ্ঞকে মরণোত্তর বীর বিক্রম উপাধি প্রদান করে তাঁর বীরত্বপূর্ণ অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা হোক। এই ঘটনায় আমাদের বিচার বিভাগ আজ নানাবিধ প্রশ্নের সম্মুখীন। দীর্ঘ ৪৭ বছর ধরে খুনের মোকর্দমাটির বিচাকার্য্য শুরুই হতে পারল না? আদালত একজনেরও সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পাললেন না। শুধুই স্থগিতের পর স্থগিতাদেশ। আইনের ফাঁক ফোঁকড় দিয়েই যে এমন ঘটনা ঘটানো হয় সমাজের প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে-তাও নতুন কিছু নয়।

মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে বিষয়টি গুরুত্ব পাবে বলে ধারণা করি। আর কালবিলম্ব নয়। দ্রুত মামলাটির নিষ্পত্তির পথ প্রশস্ত করা বাঞ্চনীয়।

মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রালয়ের কাছে আবেদন বীর মুক্তিযোদ্ধা কমলেশ বেদজ্ঞের পরিবারের যৌক্তিক আবেদন মেনে নিয়ে কমলেশ বেদজ্ঞকে বীরোত্তম হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তাঁর প্রতি রাষ্ট্রীীয় সম্মান দেখানো হউক। একই সাথে নিহত সকলেই যেহেতু বীর মুক্তিযোদ্ধা সুতরাং তাঁদেরও প্রাপ্য উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় মর্য্যাদা প্রদানে দ্রুততার সাথে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এগিয়ে আসুক।

রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক এবং সুংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উপরোক্ত ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিলে উপরতলার কাজও ত্বরান্বিত হতে পারে।

লেখক : সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।