রূপক মুখার্জি, নড়াইল : শীর্ণকায় নবগঙ্গা ও প্রমত্বা মধুমতি নদী বিধৌত ঐতিহ্যবাহী ও শতাব্দী প্রাচীন জনপদ হল, নড়াইলের লোহাগড়া। শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতির চারণ ক্ষেত্র লোহাগড়া তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। লোহাগড়ার সেই রূপ আজ আর নেই। রূপ-সৌন্দর্য হারিয়ে শ্রীহীন জনপদে পরিনত হয়ে পড়েছে শতাব্দীর স্বাক্ষী লোহাগড়া।

পৌর শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে নীতি নৈতিকতা বিরোধী কর্মকান্ড এবং অসামাজিক কার্যকলাপ দিনকে দিন বাড়ছে। ভয়াল মাদকের আগ্রাসী থাবায় সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময়ী লোহাগড়া ‘প্রায় বিপন্ন’ জনপদে পরিণত হয়ে পড়েছে। সর্বত্র মাদকের ছড়াছড়ি। হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। মাদকের সহজলভ্যতার কারণে এখানে মাদক বিক্রেতার পাশাপাশি সেবীর সংখ্যাও বাড়ছে। এখানকার মাদক সেবীদের কাছে ‘ইয়াবা’ এখন হট কেকের মতো। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দেদারসে চলছে ইয়াবা বেচাকেনা। স্থানীয় ভাবে ইয়াবাকে ‘বাবা’ ও ‘গুটি’ বলা হয়। ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় এক শ্রেণির কথিত নেতারা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অবৈধ সুযোগ সুবিধা নিয়ে ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বলে বিস্তর অভিযোগ। শুধু তাই নয়, ইয়াবা ব্যবসার সাথে বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি সম্পৃক্ত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সামনে সর্বনাশা মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কর্মকর্তারা মাদক পাচার ও বিক্রি বন্ধে তৎপর থাকলেও মাদক বেচাকেনা থেমে নেই। মাদকের সহজলভ্যতা, অপেক্ষাকৃত কম দাম এবং পুলিশী ঝুঁকি কম থাকায় লোহাগড়ার মাদক পাচারকারী ও সেবনকারীরা ‘ইয়াবা বড়ি’র নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কতিপয় অসাধু ও দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা মাসিক চুক্তির বিনিময়ে মাদক বেচা কেনায় সহযোগিতা করছেন। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অভিযোগ সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন। এমতাবস্থায় বাজারের অলিগলি, পাড়া-মহল্লা সর্বত্র মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ‘সিন্ডিকেট’ করে ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে। এক কথায়, ইয়াবায় ভাসছে লোহাগড়া।

খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে, পৌর শহরসহ উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের অর্ধ শতাধিক বাণিজ্যিক পয়েন্টে দেদারসে বিভিন্ন মাদকদ্রব্য বিক্রি হচ্ছে। এসব মাদকদ্রব্যের মধ্যে রয়েছে, ঘুমের বড়ি, গাঁজা, ফেনসিডিল, মদ ও ইয়াবা। বছর খানেক পূর্বে ফেনসিডিলের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও বর্তমানে তা কমে সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে ইয়াবা। বর্তমানে এখানে এক বোতল ফেনসিডিলের দাম ১ হাজার পাঁচশত টাকা। পক্ষান্তরে ভারতের তৈরী একটি ইয়াবা বড়ির দাম দুশো থেকে তিনশ টাকা। মায়ানমারের তৈরী, যা ‘আর সেভেন ’ নামে পরিচিত ইয়াবা বড়ি সাড়ে ৩শ টাকা থেকে ৪শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মুলতঃ দাম কম হওয়ার কারনে মাদক বিক্রেতাদের পাশাপাশি সেবনকারীরা ইয়াবার বড়ির নেশায় ঝুঁকে পড়েছে। বিশেষ করে, স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। মাদকাসক্ত এ সব শিক্ষার্থীরা অভিভাবকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মোবাইল গেম খেলায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। এ কারনে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।

লোহাগড়ায় সড়ক পথ দিয়ে মাদকদ্রব্য প্রবেশ করে থাকে। সীমান্ত শহর যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা ও কুষ্টিয়া অঞ্চলের মাদক পাচারকারী চক্র মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নিজস্ব লোকজন দিয়ে অভিনব কায়দায় মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। মাদক পাচারকারীরা মাদক পাচারের জন্য পুরুষদের চেয়ে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের মাদক পাচারে ব্যবহার করছে। এরা ‘ক্যারিয়ার’ হিসেবে পরিচিত। ক্যারিয়াররা মাদকসহ মাঝে মধ্যে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও ভুল ঠিকানা দিয়ে তারা সহজেই মামলা থেকে অব্যহতি পেয়ে যাচ্ছে। অব্যাহত অভিযানের পরেও বন্ধ হচ্ছে না মাদক ব্যবসা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার লোহাগড়া বাজার, কচুবাড়িয়া, রামপুর, লক্ষ্মীপাশা, গোপিনাথপুর, সওদাগর পাড়া, জয়পুর, কুন্দসী, মাইটকুমড়া, কলেজপাড়া, সরকারপাড়া, পোদ্দারপাড়া, মল্লিকপুর, মঙ্গলহাটা, করফা, ইতনা, ডিগ্রীরচর বাজার, পাঁচুড়িয়া, দিঘলিয়া, কুমড়ী, নোয়াপাড়া, কুচিয়াবাড়ি, এড়েন্দা, মানিকগঞ্জ বাজার, শিয়েরবর, লাহুড়িয়ার কালিগঞ্জ, কালিশংকরপুর, নলদী, মিঠাপুর, কলাগাছি বাজারসহ প্রায় অর্ধ শতাধিক পয়েন্টে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নিজস্ব লোকজনদের দিয়ে ইয়াবা বিক্রী হচ্ছে। এর মধ্যে ‘দোয়া মল্লিকপুর’ কে মিনি টেকনাফ হিসেবে অভিহিত করা হয়। স্থানীয় থানা পুলিশ মাঝে মধ্যে মাদকসহ সেবনকারীদের আটক করলেও মুল পাচারকারীরা থেকে যাচ্ছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। অতি সম্প্রতি সিএন্ডবি ব্রিজ এলাকা থেকে পার মল্লিকপুর গ্রামের ইয়াবা ব্যবসায়ী সবুজ(২৬) কে ১৯১ পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার করে র‌্যাব-৬ এর একটি দল। এত কিছুর পরেও কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না মাদক বেচাকেনা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মাদক ব্যবসায়ী জানান, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মাদক পাচারকারী চক্র লোহাগড়ার পূর্বাঞ্চলের কালনা ঘাট, মহিষাপাড়া খেয়াঘাট, বগজুড়ি খেয়াঘাট, দৌলতপুর খেয়াঘাট, কোটাকোল লঞ্চঘাটকে মাদক পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। এ সব ঘাট দিয়ে মাদকদ্রব্য রাজধানী ঢাকাসহ পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে যাচ্ছে। এ ঘাট দিয়ে মাদকদ্রব্যের পাশাপাশি অস্ত্র ও সোনা পাচার হচ্ছে বলেও অভিযোগ।

নড়াইল জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)’র উপ-পরিদর্শক (এস আই) পদ মর্যাদার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ইয়াবা বড়ি আকারে ক্ষুদ্র হওয়ায় তা সহজেই ধরা পড়ে না। তাছাড়া, দাম কম হওয়ার কারনে ইয়াবার বড়ির প্রতি সেবনকারীরা ঝুঁকে পড়েছে। সচেতন মানুষজন মাদক বেচাকেনা বন্ধে এগিয়ে না আসলে মাদক কেনাবেচা বন্ধ করা সম্ভব নয়’।

লোহাগড়া থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সৈয়দ আশিকুর রহমান জানান, ‘বেআইনি মাদকদ্রব্য উদ্ধারে জন সচেতনতা না বাড়ালে মাদকের ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না। পুলিশের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে মাদক বেচাকেনা বন্ধে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই বন্ধ হবে মাদক কেনাবেচা’।

(আরএম/এসপি/ডিসেম্বর ২৫, ২০২০)