আবীর আহাদ


মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে অমুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদের লক্ষ্যে অনেক আন্দোলন, সংগ্রাম ও লেখালেখির ফলশ্রুতিতে অবশেষে মুক্তিযোদ্ধা নামধারী ভুয়া ধরার কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে । আসছে ৯ জানুয়ারি সারা দেশে একযোগে প্রাথমিকভাবে বেসামরিক গেজেটধারীদের মধ্য থেকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই অনুষ্ঠিত হবে ।

মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় কোনো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার শংকিত হওয়ার কিছু নেই । শংকায় আছে অমুক্তিযোদ্ধারা । প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে বুক ফুলিয়ে সাক্ষ্য দিন । তাদের কেউ যেনো সামাজিক, রাজনৈতিক বা অন্য কোনো কারণে তাদের মুক্তিযোদ্ধার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন । তবে কোনো অবস্থাতেই অমুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন না । কেউ অর্থের লোভে ভুয়ার পক্ষে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে ভুয়াসহ সাক্ষ্যদাতারা কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারেন । মনে রাখবেন, অমুক্তিযোদ্ধারা আর্থিক কারণে অনৈতিক পন্থায় মুক্তিযোদ্ধা সেজে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বে ভাগ বসিয়েছে । তারা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধাদি লুটে নিয়ে নিজেরা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি আসল মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদার ওপর কলঙ্কের কালিমা লেপন করে চলেছে । তারা রাজাকারদের সমগোত্রীয় । তারা মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ, দেশ ও জাতির শত্রু ।

একথা দিবালোকের মতো সত্য যে, বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে বিভিন্ন সময় গোঁজামিল সংজ্ঞায় মুক্তিযোদ্ধা বানানোর সুযোগ সৃষ্টির পরিবেশ তৈরী করা হলেও অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় অমুক্তিযোদ্ধাদের এমনকি রাজাকারদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়ার মূল কারিগর অবশ্যই কিছু স্বার্থান্ধ মুক্তিযোদ্ধা । বিশেষ করে অতীতের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেতনাহীন ও অর্থলিপ্সু অধিকাংশ ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা কমাণ্ডার এবং কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের কর্তাব্যক্তিদের সহযোগিতায় বাণিজ্যিক ধান্দাবাজ সাক্ষ্যদাতা মুক্তিযোদ্ধাসহ ক্ষমতাসীন দলের একশ্রেণীর নেতা, এমপি ও মন্ত্রীদের কারণে অমুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা হতে পেরেছে । অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ না থাকায় পরবর্তীতে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) কোনো কোনো সদস্য ও কর্মকর্তাদের একই অনৈতিকতার কারণেও দেদারসে অমুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে । ফলে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আসল মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক অমুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছে । এটা বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি চরম পদাঘাত ছাড়া আর কিছু নয় ।

আসছে ৯ জানুয়ারি বিশেষ করে বেসামরিক গেজেটধারীদের মধ্য থেকে অমুক্তিযোদ্ধা উচ্ছেদের যে কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে, এটা একটা শুভ লক্ষণ । এ যাচাই বাছাই আনতে গিয়ে আমাকেসহ অনেককে যারপরনাই সংগ্রাম করতে হয়েছে । বিশেষ করে ভুয়া উচ্ছেদ আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে গিয়ে আমাকে ক্ষমতাবানদের চক্ষুশূলে পরিণত হতে হচ্ছে । কতোপ্রকার হুমকি ধামকি সহ্য করতে হচ্ছে । তারপরও আমরা ভয় পেয়ে গুটিয়ে যাইনি; বরং আরো বিপুল প্রত্যয় ও মনোবল নিয়ে ভুয়ার গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিরামহীন প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি । জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত ভুয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে ।

গত ১লা জানুয়ারি মুবিম মন্ত্রী বাহাদুরকে আমি ফোনে পরিষ্কার করে বলেছি, শুধুমাত্র বেসামরিক গেজেটধারীদের নয়----পর্যায়ক্রমে লাল মুক্তিবার্তা, যুদ্ধাহত, বিশেষ গেরিলা, সেনা-বিজিবি-পুলিশসহ অন্যান্য সব তালিকার ভুয়াদের বিতাড়িত না করা পর্যন্ত আমরা আন্দোলন, সংগ্রাম ও লেখালেখি করেই যাবো । মুক্তিযোদ্ধাদের পবিত্র নামের কলঙ্ক ভুয়ার গোষ্ঠীর সাথে কোনোই আপোস নেই । মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা----এ নির্মম তামাশা অবলোকন করার জন্যে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি । মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদার সাথে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা এবং বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার মর্যাদার প্রশ্ন জড়িত । মাননীয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী প্রত্যুত্তরে আমাকে কথা দিয়ে বলেছেন যে, বেসামরিক গেজেটধারীদের যাচাই বাছাইয়ের পর লালসহ অন্যান্য সব তালিকার অমুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদের জন্যে একমাস সময় দিয়ে অভিযোগ আহ্বান করা হবে । যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাবে, অবশ্যই তাদেরকেও যাচাই বাছাইয়ের সম্মুখীন হতে হবে । মন্ত্রী মহোদয়ের কথায় মনে হয়েছে যে, তিনিসহ সরকারও ভুয়া উচ্ছেদ করতে চান । আসলে অমুক্তিযোদ্ধা উচ্ছেদে প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধারাই মূল ভূমিকা পালন করতে পারেন ।

উপরোক্ত অবস্থার নিরিখে প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আবার আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, আপনারা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আত্মমর্যাদায় বলিয়ান হয়ে সব লোভ-লালসা, আত্মীয়প্রীতি ও ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ভুয়া উচ্ছেদে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করুন । আপনাদের পবিত্র নামের কলঙ্ক লেপনকারী ভুয়াদের উৎখাতের এ সুবর্ণ সুযোগ কোনো অবস্থাতেই হাতছাড়া করবেন না । আমরাই যেনো নিজেদের পায়ে কুড়াল না মারি ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।