আবীর আহাদ


এটা সর্বজন স্বীকৃত যে, মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় কমবেশি আশি হাজার অমুক্তিযোদ্ধা রয়েছে, যারা প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বে ভাগ বসিয়ে ও তাদের পবিত্র নামের মর্যাদাহানি ঘটিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তারা চরম চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় নিয়ে প্রজাতন্ত্রের অর্থ ও অন্যান্য সুবিধাদি ভোগ লুট করে নিয়ে আসছে । এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ, দেশ ও জাতির দুশমন । এদের কোনোই ক্ষমা নেই । আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ছিলাম, পরবর্তীতে নানান উপায়ে আমরা হিসেব-নিকেশ করে দেখেছি যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্নস্তরে বিভিন্ন বাহিনীতে যারা সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা হিশেবে সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের সংখ্যা ১ লক্ষ ২৫ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৫০ হাজারের মধ্যে । অথচ সরকারি তালিকায় সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লক্ষ ৩৫ হাজার। অর্থাত্ আশি/পঁচাশি হাজারই অমুক্তিযোদ্ধা, যাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও যুদ্ধের কোনোই সম্পর্ক নেই । বিভিন্ন সরকারের সময়ে গোঁজামিলের সংজ্ঞায় তারা অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে । আর তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের একশ্রেণীর অর্থলিপ্সু কর্মকর্তাবৃন্দ। আরো আছে রাজনৈতিক নেতা, এমপি, মন্ত্রী ও জামুকার কর্তাব্যক্তিরা । সত্যিকার অর্থে যদি বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তর সালের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই বাছাই করা হতো তাহলে এসব জাল-জালিয়াতির কোনো সুযোগই থাকতো না ।

বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাটি ছিলো : Freedomfighter means any person who had served as a member of any force engaged in the War of Liberation.= মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি যিনি যেকোনো সশস্ত্র দলের (ফোর্স) সদস্য হিশেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন ।" বঙ্গবন্ধুর এ মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার মধ্যে মুজিবনগর সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন মুক্তিযুদ্ধের ১১ টি সেক্টরভুক্ত সব সামরিক বাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসার, এফএফ, এমএফ, বিএলএফ (মুজিববাহিনী), ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির বিশেষ গেরিলা বাহিনীসহ দেশের মধ্যে গড়েওঠা কাদেরীয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী, হালিম বাহিনী, আফসার বাহিনী, বাতেন বাহিনী প্রমুখ সশস্ত্র বাহিনীর সব বীর মুক্তিযোদ্ধারাও পড়েন এবং সেসব সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সর্বমোট সংখ্যা ছিলো দেড় লক্ষের মধ্যে । অথচ সরকারি খাতায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ২ লক্ষ ৩৫ হাজারেরও উর্দ্ধে । এখানেই আমাদের আপত্তি ।

বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকার নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা ও যাচাই বাছাই নির্দেশিকা তৈরি করে দেয়ার ফলে সেসবের ফাঁকফোকর দিয়ে অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধা বানাতে যেয়ে আজ এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে । এ অবস্থার জন্যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকারও দায়ী । মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বিরাটসংখ্যক স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদরের যেমন মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে, তেমনি আওয়ামী লীগ সরকারও অদ্যাবধি বিরাটসংখ্যক দলীয় নেতা-কর্মীদের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়ে আসছে । তারপরও আমরা সবচেয়ে বেশি দায়ী করবো উভয় সরকারের সময়কার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের একশ্রেণীর কর্তাব্যক্তিদের । কারণ তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে দূরে সরিয়ে রেখে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার অনৈতিকতার আশ্রয় না নিলে এ বিপুলসংখ্যক অমুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আসতে পারতো না । এসব স্তরের মুক্তিযোদ্ধারা শক্ত থাকলে সরকারের ক্ষমতাবানরাও কিছুই করতে পারতো না । অপরদিকে জামুকা নামক দানব সংস্থাও একই প্রক্রিয়ায় বিশেষ করে সরকারের অনুসৃত নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে । মূল সমস্যাটা আসলে সরকারের মধ্যে । সরকার যদি মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা সম্পর্কে শক্ত অবস্থানে থাকতো, বঙ্গবন্ধুর সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাকে পাথেয় করে অগ্রসর হতো তাহলে অমুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অনুপ্রবেশ করতে পারতো না । সরকার অমুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টির ফাঁকফোকর সৃষ্টি করে দেয়ার ফলে সুযোগ সন্ধানীচক্র সেই ফাঁকফোকর দিয়ে অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় অপকর্ম করে এসেছে।

মুক্তিযোদ্ধা মর্যাদা এভাবে ধূলিসাত্ হতে দেখে শংকিত হয়েছি এই ভেবে যে, আমাদের এতো বড়ো ঐতিহাসিক শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্ব দুর্বৃত্তদের হাতে অপবিত্র হতে থাকবে ? কেউ কোনো প্রতিকারে এগিয়ে আসবে না ? ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কারণে আমরা জনগণ ও প্রজন্মের চোখে অবমূল্যায়িত হতে থাকবো ? সরকার করুণার দৃষ্টিতে দেখবে ? মিথ্যাই সত্যে পরিণত হতে থাকবে ? ইত্যাকার ভেবে আমিই সর্বপ্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকার দাবি একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ব্যানারে দেশবাসী, সরকার ও মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে তুলে ধরি এবং পর্যায়ক্রমে সংবাদ সম্মেলন, সেমিনার, আলোচনা সভা, মতবিনিময় সভা, মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান ও পদব্রজ, প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদানসহ লেখনী সংগ্রাম শুরু করলে আস্তেধীরে হলে বিশেষ করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে সাড়া পরিলক্ষিত হতে থাকে । বেশকিছু বীর মুক্তিযোদ্ধা কলমযুদ্ধে আমার সহযোগী হিশেবে তারাও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদের লক্ষ্যে রাতদিন লেখালেখি করার ফলে বিষয়টি অবশেষে সরকার প্রধানের দৃষ্টিতে আসে । তাঁর নির্দেশেই মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে অমুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদের লক্ষ্যে জামুকা একটু নড়েচড়ে বসেছে ।

জামুকার কিছু কর্মকাণ্ডের মধ্যে তাদের আন্তরিকতার দৈন্যতা ফুটে উঠেছে। কয়েক দফা তারিখ পরিবর্তন করে অবশেষে আগামী ৩০ জানুয়ারি শুধুমাত্র এক তালিকা, অর্থাত্ বেসামরিক গেজেটধারীদের যাচাই বাছাই শুরু হবে বলে তারা একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছেন । কিন্তু বেসামরিক গেজেটধারীদের যাচাই বাছাই তালিকা প্রেরণের নামে এবারও সেই তালিকার মধ্যে বিরাটসংখ্যক ভারতীয় ও লাল মুক্তিবার্তার মুক্তিযোদ্ধাদের নাম পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। যদিও জামুকা থেকে বলা হচ্ছে যে, বেসামরিক গেজেটধারীদের যাচাই বাছাই কার্যক্রমের আওতায় ভারতীয় ও লাল তালিকাধারীরা পড়বেন না, তবু যাচাই যাচাই তালিকার মধ্যে তাদের বিরাটসংখ্যকের নাম পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা কি ইচ্ছেকৃত, না করণিক ভুল তা বুঝা যাচ্ছে না । এ নিয়ে দেশব্যাপী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিশাল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।

প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধারা চান তাদের তালিকায় কোনো অবস্থাতেই অমুক্তিযোদ্ধা তথা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা থাকতে পারবে না । এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও চান । কিন্তু সরকারের নেতা এমপি মন্ত্রী ও ভুয়ারা একযোগে এ যাচাই বাছাইকে বানচাল করার জন্যে যারপরনাই আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে । আমি কয়েকদিন আগে মন্ত্রী মহোদয়কে বলেছি, আপনি আপনার সংকল্পে অটুট থাকুন, ভুয়াদের ঝেটিয়ে বিদায় করুন, দেশের সব প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধারা আপনার পাশে আছেন । এছাড়া আমি তাঁকে এও বলেছি, শুধুমাত্র বেসামরিক গেজেটধারীদের মধ্যে অমুক্তিযোদ্ধা খুঁজলে চলবে না, লাল মুক্তিবার্তা, সেনাবাহিনী গেজেট, যুদ্ধাহতসহ অন্যান্য সব গেজেটের মধ্যে অবস্থানকারী অমুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদ করতে হবে । মন্ত্রী মহোদয় আমাকে এভাবে আশ্বস্ত করেছেন যে, বেসামরিক গেজেটধারীদের যাচাই বাছাই কার্যক্রম শেষে অন্যান্য তালিকার অমুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে এক মাসের সময় দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করতে আহ্বান জানান হবে । এভাবে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাবে তাদেরকেও যাচাই বাছাই করা হবে । কয়েক মিনিট টেলিফোন আলাপের মাধ্যমে আমার কেনো যেনো মনে হয়েছে যে, ভুয়াদের উৎখাতের বিষয়ে মন্ত্রী মহোদয় এবার খুব প্রত্যয়ী । এর কারণ হিশেবে এটা হতে পারে যে, অতীতে তিনি বহু প্রতিশ্রুতি দিয়েও কোনো একটি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারার ফলে তাঁর মধ্যে একটা ব্যর্থতা ও বেদনাবোধ সৃষ্টি হয়েছে। এবারের চলমান মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি তার ব্যর্থতাকে কাটিয়ে উঠতে চান । সত্যি কথা বলতে কি, আমিও চাই তিনি সফলকাম হোন । এজন্য আমি আমার পক্ষ থেকে তাঁকে কিছু পরামর্শ দিয়েছি । আমার ধারণা, দেশের সব প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী মহোদয়ের এবারের আন্তরিকতার প্রতি দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জানিয়েছেন ।

৩০ জানুয়ারির অনুষ্ঠিতব্য মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কার্যক্রমে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কোনোই শঙ্কা নেই । তবে ভুয়ারা খুব পেরেশানে আছে । যারা সাক্ষ্য দেবেন তারা জেনেবুঝেভেবেচিন্তে সাক্ষ্য দেবেন । আমার জানা মতে, যাচাই বাছাই কমিটির বাইরে বিপুলসংখ্যক বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনী তৎপর রয়েছে। তারা এখন থেকেই সবকিছু মনিটরিং করছে । যাচাই বাছাইকালেও তারা তাদের কৌশলে তৎপর থাকবে । ফলে মিথ্যে সাক্ষ্য দিলে অবশ্যই ধরা খেতে হবে । প্রশাসনিক ও সামাজিকভাবে নাজেহাল হবেন ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।