রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : জুয়া খেলার অভিযোগ এনে হালখাতা শেষে এক রড সিমেন্ট ব্যবসায়ীসহ তিনজনকে পুলিশ বেধড়ক পিটিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ঘটনার চার দিন পরেও ওই পরিবারের সদস্যরা রয়েছে আতঙ্কের মধ্যে। গত শনিবার রাত ১২টার দিকে সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা থানাধীন ধানদিয়া ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর বাজারের পাশে অশোকের মোড়ে এ ঘটনা ঘটে।

সরেজমিনে বুধবার দুপুরে কৃষ্ণনগর বাজারের পাশে অশোকের মোড়ের বাসিন্দা সোহরাব হোসেন ও তার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম জানান, গত ৯ জানুয়ারি শনিবার সকাল থেকে তাদের বাড়ির সামনের রড ও সিমেন্ট ব্যবসাায়ি দাউদ সরদারের দোকানে হালখাতা চলছিল। দাউদ সরদার, তার ছোট ছেলে রিপন হোসেন, নতুন জামাতা আলাউদ্দিন ও একজন কর্মচারি দোকানে অবস্থান করছিলেন। রাত ১০টার পর ৬০ লক্ষাধিক টাকা হলখাতার বকেয়া আদায় হয়। ব্যাংক বন্ধ থাকায় ওই রাতে দাউদ সরদার টাকা অন্যত্র না পাঠিয়ে শার্টার লাগিয়ে দোকানের মধ্যে অবস্থান নেন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে পাটকেলঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী ওয়াহিদ মোর্শেদ ও সিপাহী পান্নাসহ চার জন পুলিশ সদস্য ওই দোকানের শার্টারে ধাক্কা দিতে থাকেন। দোকানে ডাকাত এসেছে ভেবে মালিক দাউদ ছেলে রিপনকে নিয়ে হালখাতায় আদায় হওয়া টাকা একটি বস্তায় ভরে দোতলার জানালার ফাঁকা স্থান দিয়ে বের হয়ে পড়েন।

এ সময় জুয়া খেলার অভিযোগ এনে পুলিশ পিছনে এসে পানিশূন্য ডোবার পাশে কলাবাগানে দাউদ ও রিপনকে ধরে ফেলে ব্যাপক মারপিট শুরু করে। বেধড়ক মারপিটের সময় দাউদের চিৎকারে তারা ছুঁটে এসে পুলিশের হাত থেকে বাবা ও ছেলেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। এ সময় তাদের কাছে থাকা টাকার ব্যাগটি এক পুলিশ সদস্য নিয়ে যান। ১৫ মিনিট ধরে পেটানোর পর দাউদ ও রিপনকে আবারো দোকানের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে যেয়ে ১৮ দিন আগে বিয়ে দেওয়া মেয়ে চম্পা খাতুনের স্বামী আলাউদ্দিনকেও মারপিট করেন থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এরপর শ্বশুর ও জামাতাকে একই সাথে হাতকড়া পরিয়ে মারতে মারতে পুলিশের গাড়িতে তোলা হয়। পুলিশের গাড়িতে তোলার আগে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী ওয়াহিদ মোর্শেদ রাস্তার উপর তাদেরকে( সোহরাব ও মনোয়ারা) ডেকে দাউদ ও জামাতা আলাউদ্দিনের কাছে থাকা দু’টি স্মার্ট ফোন, একটি বাটাম ফোন ও একটি টর্চ লাইট দিয়ে দেন।

অশোকের মোড়ের সাইকেল মিস্ত্রী রফিকুল ইসলাম, দাউদ সরদারের চাচাত ভাই রফিক, দাউদ সরদারের মামা শ্বশুর ইয়ার আলী খাঁসহ কয়েকজন জানান, দাউদ ও জামাতা আলাউদ্দিনকে পুলিশে নিয়ে যাওয়ার পরপরই তারা ঘটনাস্থলে আসেন। এসে স্থানীয় ফারুক মাস্টারকে দেখতে পান। শনিবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে জামাই ও শ্বশুরকে ফুলবাড়ি এলাকা থেকে ঘুরিয়ে এনে আবারো দোকানের সামনে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে হাতকড়া খুলে দিয়ে চলে যায় পুলিশ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন জানান, স্থানীয় ফারুখ মাষ্টার নিজেকে বড় মাপের আওয়ামী লীগ নেতা ও পুলিশের সোর্স পরিচয়ে এলাকার সাধারণ মানুষকে তার হাতে জিম্মি করে ফেলেছে। তার দাপটে তটস্থ ওই এলাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ও ব্যবসায়িরা। দাউদ সুদের কারবার করেন। সুদের ব্যবসা করতে হলে পুলিশের নাম করে টাকা দাবি করে ফারুক মাষ্টার। টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় দাউদের দোকানে জুয়া খেলা হচ্ছে এমন মিথ্যা খবর পুলিশকে দিয়ে ফারুক মাষ্টার এ ধরণের পরিস্থিতি সৃষ্টি করিয়েছেন বলে তারা জানতে পেরেছেন। এমনকি দাউদ ও তার জামাতাকে ছাড়াতে মোটা অংকের টাকা আদায়ের ফন্দি এটেছিল ফারুক মাষ্টার।
ধানদিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশিদুল ইসলাম জানান, মামা দাউদ সরদারকে রক্তাক্ত জখম অবস্থায় রোববার সকালে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

নির্যাতনের বর্ণনা দিতে যেয়ে দাউদের ছেলে মুদি ব্যবসায়ি লিটন বলেন, তারা এখনো আতঙ্কে রয়েছেন। তবে তার বাবা একজন সক্রিয় আওয়ামী লীগ কর্মী হয়েও এভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হলো। এ বিচার দেওয়ার জায়গা নেই। তবে বিষয়টি পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের জানানোর ফলে তাদের নির্দেশে পাটকেলঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী ওয়াহিদ মোর্শেদ সোমবার সন্ধ্যায় তার বাবাসহ কয়েকজনকে ডেকে ঘটনার জন্য দূঃখ প্রকাশ করেছেন। একইসাথে বিষয়টি কাউকে না জানানোর জন্য অনুরোধ করেন।

ধানদিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সামাদ জানান, রবিবার সকালে তাকে বিষয়টি অবহিত করেন সহকারি শিক্ষক রাশিদুল ইসলাম।

সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের জরুরী বিভাগের চিকিৎসক ডাঃ শারমিন ফিরোজ বলেন, ১০ জানুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া দাউদ সরদারের হাত, পা, হাঁটু, বুক, পিঠসহ বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত জখম ছিল।

স্থানীয় ধানদিয়া ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের সদস্য রমেশ চন্দ্র সাহা জানান, তিনি ঘটনাটি শুনেছেন। তবে নির্যাতিতরা তার কাছে মুখ খুলতে চায় না।

জানতে চাইলে দাউদ সরদার বলেন, যেটা ঘটেছে তা আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তবে পুলিশ তাকে থানায় ডেকে নিয়ে ক্ষমা চেয়েছে। তবে কোন টাকা খোয়া গেছে কিনা তা তিনি জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

পাটকেলঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী ওয়াহিদ মোর্শেদ বুধবার বিকেল সোয়া চারটায় এ প্রতিবেদককে শনিবার রাতে অশোকের মোড়ে থাকার কথা স্বীকার করেই বলেন, দাউদ সরদারকে মারপিটের অভিযোগ ঠিক নয়। তবে একটা ভুলবোঝাবুঝি হয়েছিল। সেটা মিটে গেছে।

(আরকে/এসপি/জানুয়ারি ১৩, ২০২১)