আবীর আহাদ


মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মহোদয় সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধের সময় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাদানকারীদের বিষয়ে সরকার কিছু একটা ভাবছে বলে মন্তব্য করায় সারা দেশব্যাপী 'সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা' নামক একটি বিকৃত উৎসবের ফল্গুধারা প্রবাহিত হচ্ছে । এ-প্রেক্ষিতে আমার বক্তব্য হচ্ছে, মহান মুক্তিযুদ্ধে সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা বলতে কিছু নেই । আমরা যখন বিভিন্ন সংঘবদ্ধ সশস্ত্র বাহিনীর কমাণ্ড স্থাপন করে কোনো স্থানে ঘাঁটি গেঁড়ে ছিলাম এবং সেই ঘাঁটি থেকে পাকিবাহিনীর বিরুদ্ধে আঘাত হেনেছিলাম----তখন আমাদের সহযোগী ছিলাম আমরা নিজেরাই ।

আমরা নিজেরাই বাজার করেছি, পাক করেছি, নৌকো চালিয়ছি । নিজেরাই শত্রুর অবস্থান রেকী করেছি । নিজেরাই ঘাঁটির নিরাপত্তা বিধান করেছি । নিজেরাই অস্ত্র ও গোলাবারুদ বহন করেছি । তবে মাঝে মধ্যে বিভিন্ন নদী-খাল পারাপার, পরিখা খনন, গোলাবারুদ বহন প্রভৃতি কাজে কিছু কিছু মানুষের সাহায্য নিয়েছি, এটা ঠিক । এ-জন্য তাদেরকে যথাসাধ্য পারিশ্রমিক দিয়েছি ।

প্রশিক্ষণ শেষে সশস্ত্র গ্রপে বিভিন্ন এলাকায় ঘাঁটি গড়ার পর, বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়াদির ব্যাপারে প্রাথমিক অবস্থায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, মো-ন্যাপসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহযোগিতা নিয়েছি । কিন্তু কিছুদিন পর আমরা নিজেরাই আমাদের খাদ্যের ব্যবস্থা নিজেরই করে নিয়েছি । কারণ কোনো সামরিক বা সশস্ত্রবাহিনী সামরিক নিয়মনীতির আলোকে নিজেদের সার্বিক বিষয়াদি নিজেরাই করে থাকে । আমরাও সেটিই করেছি । কারণ দেশের সব মানুষ তো মুক্তিযুদ্ধের তথা স্বাধীনতার সমর্থক ছিলো না । অন্ততঃ জনগণের ২৫/৩০% এবং বিশেষ করে পাকি প্রশাসন ও ধর্মীয় মোল্লাদের ৯০% ছিলো আমাদের বিরোধী । আরো একটু খোলাসা করে বলা যায় যে, সেসময় সমাজ ও রাষ্ট্রের বিপুলসংখ্যক প্রভাবশালীরা ছিলো মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে । ফলে মুক্তিযুদ্ধের স্বার্থে এবং সামরিক নিয়ম মোতাবেক আমরা মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের যাবতীয় কার্যক্রম নিজেরাই করেছি ।

মুক্তিযোদ্ধা----মুক্তিযোদ্ধাই । যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, অস্ত্র ধরেছেন এবং ফোর্সবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করেছেন, তারাই মুক্তিযোদ্ধা । মুক্তিযুদ্ধের এ-আলোকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সনের ৭ আগস্ট একটি গেজেট জারি করে মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা নির্ধারণ করে গেছেন । এর বাইরে আর কোনো সংজ্ঞা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয় । বঙ্গবন্ধুর সেই মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাটি হলো : Freedomfighter means any person who had served as a member of any force engaged in the War of Liberation= "মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি, যিনি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত যেকোনো সংগঠিত সশস্ত্র দলের (ফোর্স) সদস্য হিশেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন ।" অতএব মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞায় সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা বলতে কিছুই নেই । যারা বঙ্গবন্ধু প্রণীত মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা মানে না-----তারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, তারা বঙ্গবন্ধুবিরোধী-----তারা রাষ্ট্রদ্রোহী ।

তবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিলো একটি জনযুদ্ধ । জনযুদ্ধের আলোকে দেশের সিংহভাগ জনগণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে পাকিবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার আলবদর আলশামস ও তথাকথিত শান্তি কমিটির হাতে নিহত-আহত হয়েছে । অত্যাচারিত ও নিগৃহীত হয়েছে । লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের শিকার হয়েছে । অগণিত মা-বোনেরা সম্ভ্রম হারিয়েছে । সার্বিক নিরাপত্তার কারণে কোটি মানুষ শরণার্থী হয়েছে । তারাও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অংশ । মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাদেরকে 'মুক্তিকামী' অভিধায় সম্মানিত করা যেতে পারে ।

অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগসহ মস্কোপহ্নী কমিউনিস্ট পার্টি, ভাসানী-মো-ন্যাপ ও বাংলাদেশ কংগ্রেস, তৎকালীন এমএনএ, এমপিএ, কেন্দ্রীয় জেলা মহকুমা ও থানার নেতৃবৃন্দ, মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী, বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশকারী কূটনৈতিক মিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্বাধীন বাংলা বেতারের শব্দ সৈনিক ও অন্যান্য কলাকুশলী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, খেলোয়াড়, চিকিত্সক প্রমুখ ব্যক্তিবর্গও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অংশ । তাদেরকে 'মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক' হিশেবে সম্মানিত করা যেতে পারে ।

উপরোক্ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবং মুক্তিযুদ্ধের আলোকে তথাকথিত 'সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা' বলতে কিছুই নেই । মূলত: অযোগ্য ও অপদার্থ জামুকা, যারা বিগত একটি যুগ ধরে যেখানে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সঠিক তালিকা করতে পারেনি, সেখানে সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা নামক একটি অবাস্তব টার্ম সৃষ্টির যে বাহুল্য পাঁয়তারা করছে, এর মূলে রয়েছে একটি বিশাল বাণিজ্যিক প্রকল্প । ২০১৭ সালের তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই নামে যে মহাবাণিজ্যের মধ্য দিয়ে হাজার কোটি টাকার হোলিখেলা হয়েছিলো, সেই একই বাণিজ্যিক ধান্দায় তথাকথিত সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা নামের প্রকল্পটি ফাঁদা হচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই ।

বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক এবং জামুকার একজন প্রভাবশালী সদস্য সাবেক মন্ত্রী, যাদের মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে যুদ্ধের কোনোই অভিজ্ঞতা নেই, তারাই বছরখানেক আগে এই তথাকথিত 'সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা' নামক বাণিজ্যিক প্রকল্প ফেঁদেছিলেন । সেই প্রকল্পটি হয়তো আবার তারা সামনে নিয়ে আসতে চাচ্ছেন । এ বাণিজ্যিক প্রকল্পের মাধ্যমে তারা হয়তো লাভবান হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন----কিন্ত তাদের এ উদগ্র বাণিজ্যিক মিশনের পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধের অবশিষ্ট চেতনা চিরতরে হারিয়ে যাবে । গোটা মুক্তিযুদ্ধ একটি তামাশার বস্তুতে পরিণত হবে ।

কিন্তু জাগ্রত বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনায় উজ্জীবিত যুবসমাজ ও দেশবাসী কোনো অবস্থাতেই মুক্তিযুদ্ধের নামাবলি জড়ানো বাণিজ্যিক ও মাফিয়া দানবচক্রকে 'সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা' নামক মুক্তিযুদ্ধবিনাশী আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে দেবে না ।

অতএব, সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা নামক প্রকল্পের চিন্তাটা বাদ দিয়ে, মুক্তিযোদ্ধাদের বিদ্যমান তালিকা থেকে অমুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদের কার্যক্রম জোরদার করুন ।

(চলবে-----)

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।