রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা গ্রামে আব্বাস গাজীকে অপহরণ ও তার স্ত্রী এবং মেয়েকে শ্বাসরোধ করে হত্যার ঘটনায় দায়েরকৃত দু’টি মামলায় ১৬ বছরেও বিচার সম্পন্ন হয়নি। ফলে গ্রাম ছেড়ে  অন্যত্র বসবাসকারি আব্বাস গাজী নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন।

শ্রীউলা গ্রামের বসিরউদ্দিন গাজীর ছেলে আব্বাস গাজী জানান, তাদের গ্রামের আব্দুস সামাদ মোল্লার ছেলে মিজানুর রহমান বাবু একই এলাকার এক মাছ ব্যবসায়ির টাকা ছিনতাইকারি হিসেবে ১৯৯৮ সালে জেল যাওয়ার পর থেকে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ২০০৪ সালের প্রথম দিকে তিনি জমি বিক্রি করে ৬০ হাজার টাকা জনতা ব্যাংকের আশাশুনি শাখায় রাখেন। এর কিছুদিন পর তার স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় তালাক দেওয়ার জন্য দেড় লাখ টাকা প্রয়োজন হওয়ায় মিজানুর রহমান বাবু তার কাছে কিছু টাকা দাবি করে। একপর্যায়ে ২০০৪ সালের ২৮ জুন সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে মিজানুর রহমানসহ কয়েকজন তাকে ডেকে এনে গভীর রাতে হাড়িভাঙা স্কুলের পুকুর থেকে মাছ ধরতে বলে।

কিছুক্ষণপর ওই পাহারাদারসহ কয়েকজন চলে এলে মিজানুর ও অন্যরা পালিয়ে যায়। পাহারাদাররা তাকে ধরে ব্যাপক মারপিট করে ২৯ জুন সকালে শ্রীউলা ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে যায়। সেখানে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করার পর তাকে মিজানুর রহমান বাবু, পলাশ ও ভাইয়ের জামাই আবু সাঈদ তাকে চিকিৎসা দেওয়ার নাম করে আশাশুনি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে একটি প্রাইভেটকারে করে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে বাবু ও সাঈদ তাকে ও তার স্ত্রীকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে চাপড়া ব্রীজের উপর গাড়ি থামিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে দিতে বলে।

একপর্যায়ে আবু সাঈদ তার (আব্বাস) স্ত্রী শাহানারাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে চেক বই এনে কৃষি ব্যাংক এর আশাশুনি শাখা ও জনতা ব্যাংকের শাখা থেকে মোট ২৩ হাজার টাকা তুলে নেয়। পরে তাকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করালেও ২জুলাই সকালে তার বিরুদ্ধে ডাকাতি মামলা হয়েছে এমন কথা বলে অসুস্থ অবস্থায় মিজানুর, পলাশ ও সাঈদ ছুটি করিয়ে খেজুরডাঙির আলীম চেয়ারম্যানের ঘেরের বাসায় নিয়ে তাকে আটক রাখে। সেখানে তার কাছে ৮০ হাজার টাকা অথবা জমি লিখে দেওয়ার কথা বলে। ওই দিন দুপুরে পাহারাদার পলাশের চোখ এড়িয়ে তিনি বেতনা নদীর ধার দিয়ে ঋশিল্পীর পাশে একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন। ওই দিন সন্ধ্যায় তিনি পূর্ব পরিচিত আলীপুর ঢালীপাড়ার মান্দার সরদারের বাড়িতে চলে যান।

তাকে না পেয়ে ইউনিয়ন পরিষদে জরিমানার ১০ হাজার টাকা দাবি করায় ১০ জুলাই আশাশুনি থানায় মিজানুর রহমান বাবুসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে ৩৫১ নং সাধারণ ডায়রী করেন শাহানারা। এ সময় তাদের ছেলে মাসুম বিল্লাহ খুলনায় তার নানার কাছে থাকতো। ১৩ জুলাই সকালে তাকে দেখতে স্ত্রী কানের দুল বন্দক রেখে ২০০টাকা চাইলেও টাকা দেয়নি আব্দুর রহমান। ওই দিন রাত ৯টায় ফুফুর বাড়ি থেকে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় দূর থেকে বাবুসহ কয়েকজনকে দেখে শাহানারা ফুফুর বাড়িতে ফিরে যেয়ে সব ঘটনা বলে রাত ১০টার দিকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেও ফিরতে পারেনি। পরদিন সকালে সামাদ মোল্লার পুকুরের পানিতে সাত বছরের শিশু মাসুমার মৃতদেহ ও পুকুর পাড়ের চটকা ফুল গাছের ডালে ঝুলন্ত অবস্থায় শাহানারার লাশ পাওয়া যায়। তার ভাই আকবর আলী তড়িঘড়ি করে এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যু(২১/৪) মামলা করেন। ওই দিন সকালে তিনি খবর পেলেও মিজানের ভয়ে বাড়িতে যেতে পারেননি।

একপর্যায়ে পুলিশ সুপার আব্দুর রহিমের সহায়তায় ১৫ জুলাই লাশ ময়নাতদন্ত শেষে আশাশুনি থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সহায়তায় গ্রামে যেয়ে মেয়ে ও স্ত্রীর লাশ দাফন করে নিরাপত্তাজনিত কারণে ১৫ দিনেও বেশি সময় আশাশুনি থানায় অবস্থান করেন। তিনি নিজে বাদি হতে না পারায় উপপরিদর্শক সামাদ খান বাািদ হয়ে মিজানুর রহমানকে প্রধান আসামী করে জুলফিকার সরদারসহ সাতজনে আসামী করে ওই বছরের ১৫ জুলাই থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। একইভাবে ওই বছরের ২০ জুলাই তিনি বাদি হয়ে মিজানুর রহমানসহ তিনজনের বিরুদ্ধে থানায় একটি অপহরণ মামলা করেন। হত্যা মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা উপপরিদর্শক একেএম নজিবুল ইসলাম ২০০৪ সালের ৮ নভেম্বর মিজানুর রহমানসহ ১২ জনের নাম উল্লেখ করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

এ মামলার প্রধান আসামী হাইকোর্ট থেকে ওই বছরের ১৬ আগষ্ঠ অর্ন্তবর্তীকালিন জামিন নিয়ে পহেলা সেপ্টেম্বর নিম্ন আদালতে হাজির হলে জামিন পান। হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দাখিলের তারিখে এজাহারভুক্ত তিনজনের নাম উল্লেখ করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা উপপরিদর্শক জসীমউদ্দিন। তবে অপহরণ মামলায় মিজানুর রহমান জেল হাজতে যান।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, দু’টি মামলা চলমান অবস্থায় শ্রীউলা গ্রামের তারক মণ্ডলের বাড়িতে ডাকাতির মামলায় তার নামে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এ মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করানো হলে কোর্ট লকআপে থাকাকালিন তার সহপাঠি সেলিম নামের একজন আইনজীবী তার কাছ থেকে মামলা থেকে বাঁচিয়ে দেওয়ার নাম করে কয়েকটি নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে সাক্ষর করিয়ে নেন। যা পরে মামলার আপোষনামা হিসেবে দেখানো হয়েছে।

আব্বাস গাজী জানান, হত্যা মামলাটি বর্তমানে সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতে বিচারাধীন। অতিরিক্ত পিপি অ্যাড. আব্দুস সামাদের তত্বাবধায়নে মামলায়(সেশন ১২৪/০৭) সাক্ষী হয়েছে তদন্তকারি কর্মকর্তাসহ আট জনের। তবে আগামি ধার্য দিন ৭ ফেব্র“য়ারি তার সাক্ষী ও জেরা করার জন্য আসামীপক্ষের আবেদনের ভিত্তিতে দিন ধার্য করেছে আদালত। একইভাবে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদলতে বিচারাধীন অপহরণ মামলটি (সেশন ১৪/০৬) অতিরিক্ত পিপি অ্যাড. তপন কুমার দাস এর তত্বাবধায়নে পাঁচজন সাক্ষী শেষ হয়েছে। গত ১০ জানুয়ারি সাইফুল ও জাহিদুর রহমানের সাক্ষীর জন্য দিন থাকলেও তারা আসেনি। তবে আগামি ধার্য দিন দিনি জানেন না।

তিনি জানান, দু’টি মামলা অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে একসঙ্গে বিচার চললে তিনি ন্যয় বিচার পেতেন। তিনি আক্ষেপের সঙ্গে বলেন রাষ্ট্রপক্ষ আন্তরিক হলে এ মামলা দু’টির বিচার শেষ হতে ১৬ বছর নয়, তিন বছরে শেষ হতো। তাহলে তিনি গ্রাম ছেড়েও নিরাপদে থাকতে পারতেন।

জানতে চাইলে অতিরিক্ত পিপি অ্যাড. আব্দুস সামাদ ও অ্যাড. তপন কুমার দাস বলেন, অনেক সময় সাক্ষীরা নোটিশ পেয়েও আসেন না। ফলে বিচার কার্য বিলম্বিত হয়। আগামিতে যাতে এ সাক্ষ্য গ্রহণের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা যায় সেজন্য তারা সচেষ্ট থাকবেন।

(আরকে/এসপি/জানুয়ারি ২৫, ২০২১)